‘শ্বশুরবাড়ি মধুর হাড়ি’ প্রবাদটি প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু ‘স্থান-কাল-পাত্র’ বলেও একটা কথা সমাজে বহুল প্রচলিত। এই জ্ঞানটুকু না থাকলে শ্বশুরবাড়িতেও জামাইর ভাগ্যে ‘মধুর হাড়ি’ জুটেনা। অর্থাৎ সময়জ্ঞানকে তোয়াক্কা না করে অসময়ে বেড়াতে এলে শ্বশুরবাড়ির জামাইরও খুব একটা কদর থাকেনা। বর্তমানে বিশ্বজুড়েই করোনা ভাইরাসের দোর্দণ্ড দাপট। কভিড-১৯’র এই সংক্রমণকালে সমাজের কতিপয় মানুষের অতিমাত্রায় ট্রল করার নানান কিছিমের দৃশ্যপট অবলোকন করতে করতে ছোট্টকালে গাঁয়ের মুরুব্বীদের মুখে মুখে শোনা চটকদার ওই গল্পটা বারংবার মনে পড়ছে।
প্রকৃতিতে তখন ভরা কার্ত্তিক মাস। অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে চাষকৃত ‘বর্ষাল ধান’ কেটে ঘনে তোলার উপযুক্ত সময়। প্রতিটা গেরস্থ বাড়ির ছেলে-বুড়োই মহাব্যস্ত ধান কাটায়। অমনি সময়ে জামাই বেচারা শ্বশুরালয়ে বেড়াতে এসেও যেন অনেকটা বেকায়দাতেই পড়লেন। বাড়িজুড়েও নেই কোনো পুরুষ মানুষ। কারোর সাথে দু’দণ্ড বাক্যালাপেরও সুযোগ নেই। অনেকেই হয়তো বিরক্তিভাজন হচ্ছেন ভেবেই জামাই বেচারা নিজেকে বেশ পারঙ্গম প্রমাণ করতেই শাশুড়ির নিকট একখান কাস্তে চেয়ে নিয়ে ধান কাটার উদ্দেশ্যে ক্ষেতের পানে ছুটলেন। কিন্তু ক্ষেতের নিকটে গিয়ে তো জামাই বেচারা পড়লেন মহা বিপাকে।
বর্ষাকালে পানিতে ভাসমান থাকে বর্ষাল ধান। পানি সরে যাবার পর ধানগুলো এমনভাবে এলোমেলো অবস্থায় মাটিতে বিছিয়ে পড়ে যে, মাথামুণ্ড খুঁজে পাওয়াটাও দুস্কর। কাস্তে হাতে নিয়ে ক্ষেতের চারপাশে ঘুরেও এমন এলোকেশী দশায় পড়ে থাকা ধান কিভাবে যে কাটবেন তার কোনো উপায়ই পাচ্ছিলেন না জামাই বেচারা। নিজে নিজেই অতি বাহাদুরি দেখাতে এসে এখন অনেকটা বেইজ্জতি হবার দশাতেই নিপতিত। ভাবনার অতলে ডুবেও খুঁজে পাচ্ছিলোনা কোন উপায়। এভাবে কেটে গেলো অনেকটা সময়। এদিকে দুপুর গড়িয়ে পড়ায় পেটের ভেতরকার অবস্থাও বেশ কাহিলই বলা চলে। কোনোরূপ উপায় বের করতে না পেরে অনেকটা ব্যর্থ মনোরথেই বাড়িমুখো হলেন।
ধান কাটতে না পারলেও জামাই বেচারার মানসিক গলদঘর্ম দশাটি শাশুড়ি ঠিকই বুঝতে পারলেন। দুপুরের খাবারের সময় বয়ে যাচ্ছে, কালবিলম্ব না করে গোসল সারার তাগিদ দিলেন। শাশুড়ির তাড়ায় চটজলদি গোসলটা সেরে খেতে গেলেন। কিন্তু শাশুড়ির খাবার সাজানোর অবস্থা দেখে জামাই বেচারা পড়লেন নতুন করে আরেক বড্ড বিপাকে। না পারছেন খেতে, না পারছেন কিছু বলতে। ক্ষেতে ধান কাটতে না পারার ধকলটাতো কেউ দেখেনি, কিন্তু এবার নিজেকে সামলাবেন কি করে! কোনোরকম উপায় খুঁজেও পাচ্ছিলেন না। কখন যে শাশুড়ি কিংবা অন্য কেউ এসে দু’কথা শুনিয়ে দেবে, এই নিয়ে পড়লেন মহা ভাবনায়।
জামাইবাবুর খাওয়ার কোনরূপ আলামত না পেয়ে এবার শাশুড়ি সামনেই চলে এলেন। লজ্জা-অপমানে জামাই বেচারার মাথা কাটা যাবার যোগাড়। শাশুড়ি এবার বলেই ফেললেন, কিহে বাপু খাচ্ছেন না কেন? জামাই বেচারা এবার আমতা আমতা করে বলতে লাগলেন- না মানে আম্মাজী, ভাতের চারদিকে এরকম সুন্দরভাবে নানান রকমের তরকারি সাজিয়ে দিয়েছেন; কোনটা রেখে কোনটা খাবো এবং কিভাবে খাবো সেটাই ঠিক বুঝে ওঠতে পারছি না, তাই —-! সত্যি বলতে, ক্ষেতের ধানগুলোও ঠিক এমনি এলোমেলোভাবেই পড়ে থাকার জন্যই জামাই বেচারা ধান কাটার উপায়ই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ক্ষেতের ধান ক্ষেতে রেখেই চলে অাসতে বাধ্য হয়েছিলেন।
জামাই বলে কথা। শাশুড়ি কি তার মেয়ের জামাইকে না খাইয়ে উপোস রাখতে পারেন? তাই এগিয়ে এসে ভাতের থাকার চারদিকে সাজিয়ে রাখা তরকারি একদিক থেকে খানিক সরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এভাবে বাইল কইরা খাও’। শাশুড়ির কথা-সহযোগিতায় জামাই বেচারা এবার খাওয়ার উপায়টা পেয়ে গেলেন। তবে তার জন্য শাশুড়িকে ধন্যবাদ জানাতে মোটেও ভুল করলেন না। এদিকে সুযোগ পেয়ে এবার শাশুড়ি মহাশয়াও বলেই ফেললেন,- ‘বাবা সকল কাজেরই বাইল (উপায়) জানা লাগে। না জানা কাজ প্রথমবার করতে গেলে একটু খটকা তো লাগবেই, এটাই যে স্বাভাবিক। তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে বুদ্ধি খাঁটিয়ে, সাহস করে শুরু করলেই যেকোনো অসাধ্য কাজও সাধন করা যায়।
বলতে চেয়েছিলাম, বর্তমান ধান কাটার মৌসুমে কৃষকের ক্ষেতে ধান পেকে থাকলেও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণজনিত কারণে কামলা না পাওয়া, কামলার খরচ যোগাতে না পারার কারণে বাংলার প্রাণ কৃষকদের নিয়ে একরকম ট্রল করার কথা। ধান কাটা নেহায়েত সহজতর কোনো কাজ নয়। কৃষক পরিবারে জন্মেছি, কৃষি কাজের পাশাপাশিই করেছি পড়াশোনা। সঙ্গতেই সবটুকুনই জানি। গতর খাঁটিয়েই জমিতে কাজ করতে হয়। সুদৃশ্য পোষাক পরিচ্ছদে ফুলবাবু সেজে অার যাই হোক, জমিতে কাজ করা যায় না। খাইতে গেলও যেমন বাইল করেই খেতে হয়, ঠিক তেমনিভাবে কোনো কাজ করার বাইল অর্থাৎ উপায় জানতে হয়। তার বদলে সস্তা ধন্যবাদ কুড়ানোর ধান্ধায় এসব করতে যাওয়াটা দেশের প্রাণ কৃষকদের সাথে তামাশা করা, তাদেরকে উপহাস করারই সামিল। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণজনিত এই মহামারীকালে অন্তত অামাদের মাঝে শুভ বোধের উদয় হোক।
বি. দ্র. জমিতে ধান কাটার তথাকথিত নাটকীয় ছবিগুলো ফেসবুক থেকে নেয়া।
লেখক- এইচ. এম. সিরাজ
সাংবাদিক, শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট
নির্বাহী সম্পাদক : দৈনিক প্রজাবন্ধু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
তারিখ : ২৮.০৪.২০২০ খ্রিষ্টাব্দ।
Leave a Reply