‘তুমি একটা আস্ত সেলফিস!’ মানে চরমতম স্বার্থপর। তোমার অন্তরে কোনো মায়া-দয়ার লেশমাত্রও নেই। এজাতীয় কথা আগে মানুষ বলাবলি করতো। এখন হয়তোবা আর ঠিক ততোটা বলে না! কারণ, ‘সেলফিস’ শব্দের ব্র্যাণ্ডটাই হয়তোবা ‘সেলফি’ ব্যাটা সুনামসমেতই এক্কেবারে কিনে নিয়েছেন! তবে সমাজ-রাষ্ট্রে প্রচলিত ট্রেডমার্ক আইন অনুযায়ী ওই ক্রয় করার ‘দলিলপাট্টা’ কতোখানি পাকাপোক্ত করেছেন তা অবশ্য যাচাই করে দেখা দরকার বৈকি।-যে কথাটি বলতে যাচ্ছিলাম। গত কয়েকদিন আগে এক ছেলে নিজের বাবার শবদেহ অন্যান্যদের সাথে কাঁধে নিয়ে গোরস্থানের দিকে যাচ্ছিলো।শবদেহবাহী খাটিয়ার সামনের দিকের এক কোণে থাকা সদ্য পিতৃহারা হওয়া ওই যুবক নিজের এণ্ড্রয়েড মোবাইল ফোনের সাহায্যে ঠিক সেই মুহূর্তটির একটা ‘সেলফি’ তুললেন। অত:পর উত্তোলিত সেই সেলফি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে আপলোড দিয়েছেন! ছবিটার ক্যাপশনে লিখেছেন, “আমি এবং আমার কাঁধে বাবার লাশ, কবরের দিকে যাচ্ছি। সবাই অামার বাবার জন্য দোয়া করবেন।” এরকম যে শুধুমাত্র ঐ যুবকটিই করেছেন বা করছেন, তা কিন্তু নয়। এই চিত্র আজকাল অহরহই দৃষ্টিগোচর হয়েই থাকে।-ফেসবুকের বদান্যতায় আজকাল বহু বিচিত্র জিনিসের সন্ধান পাওয়া যায় বটে। এইতো সেদিন একজন যুবতি মেয়ে রিকশাযোগে কোথাও যাচ্ছিলেন। বেচারি হয়তো তার মনের খায়েশ মিটাতেই রিকশায় আরাম করে বসে নিজের মোবাইল ফোনে তুললেন একখানা ‘সেলফি’। রিকশারোহী ওই যুবতি এবার তার সেই ছবিটি নিজের ফেসবুকের টাইমলাইনে আপলোড দিলেন। আপলোড করা ছবিটার ক্যাপশনের পর ফটো ক্রেডিট হিসেবে লিখলেন- ‘প্রতিবন্ধী’। এটি দর্শনে তারই এক ফেসবুক বন্ধু কমেন্ট করলো, ‘এতোদিন জানতাম “প্রতিবন্ধী স্টাইল” ফটোশুট হয়, কিন্তু ফটোগ্রাফার “প্রতিবন্ধী” হয় এই প্রথম শুনলাম…!’ এজাতীয় আরো নানান কমেন্ট করেছেন নানাজন। কিন্তু বেচারি বেশ মজাই পেয়েছেন বটে। তার প্রমাণ, কমেন্টকারীদের কমেন্টের জবাবেও ভিন্নরকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।-যারা ফেসবুক ইউজার তাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে,পবিত্র রমজান মাসে তারাবিহ্ নামাজের সময় সেজদারত এক মেয়ের ‘সেলফি’ তোলার কথা! বেচারি হয়তোবা ওই সেলফি’র মাধ্যমে এটাই বুঝাতে চাইলেন যে, তিনি রমজান মাসে পবিত্র তারাবিহ্ নামাজ পড়েন! সত্যিকারার্থে, কতোটা অসুস্থ অার বিকৃত মানসিকতার অধিকারী হলে এমনটি করা যায়? তার এহেন হেয়ালি দৃশ্যটি জনমনে কতোটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে? এমনটি কি অাদৌ তিনি ভেবেছেন? অার যদি ভাবতেন, তাহলে কদ্যপিও কি এমনটা করতে পারতেন? এরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ কিন্তু সে একাকী করেনি। অনেকেই এমনটি করে থাকেন, করছেন বলেই সেও তার মনের খায়েশে করার দু:সাহস দেখিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আবার অনেক বাহবাও পেয়েছেন!-কিছুদিন আগে দেখলাম আরেক অভাবনীয় দৃশ্য। এক ছেলের মা ইন্তকাল করেছেন। মাতৃহারা ছেলেটা গেলেন গোরস্থানে।সেখানে গিয়ে তার মায়ের চিরন্তন বসবাসের জন্য খোড়া কবরের পাশেই দাঁড়িয়ে একখানা ‘সেলফি’ তুললেন। পরে নিজ ফেসবুক দেয়ালে ছবিটা অাপলোড করলেন। অপরদিকে আরেক যুবক তার মৃত দাদার লাশের সাথে ‘সেলফি’ তুলেছে! ছবিটি নিজের ফেসবুক ওয়ালে অাপলোড করে ক্যাপশনে লিখলেন, ‘গুডবাই দাদু’।-জনৈক ছাত্র গিয়েছেন বিদ্যালয়ে। এবার ছাত্রটি কি না কি ভেবে তার শ্রেণীকক্ষে বসেই মোবাইলে একখানা ‘সেলফি’ তুললেন। সেলফি’র ওই ছবিটিকে এবার তার নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে করে দিলেন আপলোড। সে যাই হোক, এফবিতে অাপলোডকৃত তার ছবিটির ক্যাপশনে যা লিখলেন সেটি দেখলে যে কেউই ভিমড়ি খাবেন। তিনি ক্যাপশনে লিখলেন, “ম্যাডাম কিন্তু হেব্বি” ফটো ক্রেডিট- “বলদ”!-বিখ্যাত গাবখান ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে এক যুবক তার বন্ধুদের সাথে একটি গ্রুপ ‘সেলফি’ তুললেন। তাদের ওই গ্রুপ সেলফিটি এবার নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে আপলোড দিয়েছেন ওই যুবক। ফেসবুকের দেওয়ালে অাপলোডকৃত গ্রুপ সেলফি’র ক্যাপশনটিতে যুবকটি লিখলেন,”উই অল গাইজ আর রকজ, মালের ভ্যাট শকজ।”-এক ব্যক্তি মক্কা শরীফে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করতে গেলেন। পবিত্র কা’বা শরীফের সামনে দাঁড়িয়ে বেচারা তার মোবাইল ফোনে তুললেন একখান ‘সেলফি’। এবার ওই সেলফি তারই ফেসবুক টাইমলাইনে আপলোড দিয়েছে! তাও বড় কথা নয়, বেচারা তার আপলোড করা ছবিটির ক্যাপশনে লিখেছে,”it’s imagine, I’m LOL.”!
আরেক ব্যক্তিকে দেখলাম হজ্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ পালন শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপকালে নিজেরই মোবাইলে সেলফি তুলছেন! পবিতো হজ্বব্রত পালণের উদ্দেশ্যে পবিত্র নগরীতে গমণকারি ওইসব বেচারাগণ কেমন মানসিকতার?-এই যখন আমাদের সেলফি প্রেম কিংবা বাপের টাকায় DSLR কিনে রাতারাতি ডিজিটাল ফটোগ্রাফার সেজে ছবি তোলা, আর এসবের ক্যাপশন; তখনই মনে পড়ে যাচ্ছে কেভিন কার্টারের কথা। সেই ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের কথা। কেভিন কার্টার সুদানে একটি ছোট্ট বাচ্চার ছবি তুলেছিলেন। কঙ্কালসার ওই বাচ্চাটি হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছিলো খাবারের জন্য। আর পাশেই একটি শকুন অপেক্ষা করছিলো বাচ্চাটি মারা যাবার জন্য——–! কেভিন ওই বাচ্চাটিকে খাবার পেতে সহায়তা না করার যন্ত্রনায় পরবর্তীতে আত্মহত্যা করেছিলেন।-সাম্প্রতিককালে সাগর পাড়ের আইলানের ছবি তোলা অতি সাধারণ সেই ফটোগ্রাফারের কথাই ধরুণ! যেই ছবিটি সারা দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো! চাইলে আমরাও আমাদের ক্যামেরার লেন্সটি কাজে লাগিয়ে আমাদের সমাজের অনেক অসঙ্গতি তুলে ধরতে পারি সারা বিশ্বের কাছে। অথচ আমরা কি করছি? আমরা ছবি তুলি মানসিক প্রতিবন্ধীর মতো। আর উঠানো ওইসব ছবিতে ক্যাপশন দিই অনেকটাই উন্মাদের মতো! পশ্চিমা দুনিয়ার অপসংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে আমাদের মস্তিষ্কও যে দিন দিন বিকৃত থেকে অতি বিকৃত হয়ে যাচ্ছে এগুলোই তার প্রমাণ নয় কি?
লেখকঃ এইচ.এম. সিরাজ। কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, পাঠাগার ও ক্রীড়া সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।
Leave a Reply