শান্তনু কায়সার, কবি জয়দুল হোসেন, ড. সাহাব উদ্দিন বাদল এবং মানিক রতন শর্মা। অদ্বৈত মল্লবর্মণ জন্ম-১৯১৪-মৃত্যু-১৯৫১। তৃণমূল থেকে উঠে এসেছিলেন যে প্রান্তিক সম্প্রদায়ে তাঁর জন্ম তাকে তিনি বিস্মৃত হনইনি বরং শিল্পবিন্যাসে বিশ্বমানে উন্নীত করেছেন। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে যাঁর মৃত্যু এঁরাই এ ভূ-খণ্ডের এই ব-দ্বীপের প্রকৃত কুশীলব। হাসিম শেখ, রামা কৈবর্ত, তোরাপ, রাইচরণ, কুবের মাঝি হয়ে “তিতাসে” যারা সুবল অথবা কিশোর কিংবা বন্দে আলী বা করম আলীতে পরিবর্তিত তারাই তো বৃহৎ জনপদের মৃত্তিকালগ্ন মানুষ। অদ্বৈতর আত্মজৈবনিক আদলে সৃষ্ট অনন্ত এই কাজটিকে এগিয়ে নিতে না পারলেও বাসন্তীর স্পর্ধা ও ভালবাসা তা আজও অনুরণিত। সেই বোধ থেকে শিল্প ও সৌন্দর্যের অগ্নি প্রজ্জ্বলনই আমাদের অন্বিষ্ট। তিনি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সুগভীর অন্তঃদৃষ্টির কারণেই উপন্যাসটিতে ধীবর সমাজের নিষ্ঠুর জীবন সংগ্রামের সাধারণ কাহিনীকে দিয়েছেন অবিনশ্বর ও অসাধারণ। কথাগুলো বলছিলেন অদ্বৈত গবেষক সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন। যার অফুরন্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অসংখ্য গবেষক তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, যেভাবে আমরা রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী করি ঠিক সেভাবেই অদ্বৈত মল্লবর্মণ জয়ন্তী উদযাপন শুরু করি। অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস রচনা করেন। তখন তিনি কলকাতার একটি পত্রিকায় চাকরী করতেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা (সরকারি) উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে আইএ পাস করার পূর্বেই কলকাতা চলে যান। সেখানে তিনি একটি পত্রিকায় চাকরী করেন। লেখালেখি করেছেন কবিতা গল্প ও উপন্যাস। তাঁর লেখা কখনও পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে কখনো বা পায়নি। তবু তিনি লিখে গেছেন। তিনি নিজে যা করেছেন বা নিজে যা দেখেছেন জেলে পরিবারের জনজীবন, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে তাদের চাল চলন জীবনযাপন যেমন ছিল এগুলো নিয়ে লিখেছেন। তিতাস একটি নদীর নাম লিখে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় দিয়েছিল ধারাবাহিক প্রকাশ করার জন্য। মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রথম পর্ব ছাপানোর পর অদৃশ্য কারণে পরবর্তি সংখ্যাগুলো আর ছাপা হয়নি। যদিও লোকমুখে প্রচলন ছিল অদ্বৈত মল্লবর্মণ জেলে সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে তার উপন্যাসটি আর ছাপা হয়নি। সম্পাদককে বিষয়টি অবগত করলে সম্পাদক বলেন, আপনার পাণ্ডলিপিগুলো হারিয়ে গেছে। এরপর অদ্বৈত মল্লবর্মণ দ্বিতীয় বার উপন্যাসটি লিখেন। লেখার পর পূর্ণ প্রকাশ হওয়ার পূর্বে ১৯৫১ সনে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পর ১৯৫৪ সনে তাঁর বন্ধুরা মিলে কলকাতার পুঁথিঘর নামক প্রকাশনী থেকে উপন্যাসটি পূর্ণ প্রকাশ করেন। উপন্যাসটি যথাযথ বোদ্ধাদের হাতে পৌঁছায়নি বলেই উপন্যাসটি এতটা আলোচিত হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ পাঠকের হাতে না পৌঁছার কারণে তা গুরুত্ব পায়নি। ১৯৭২ সালে যখন বাংলাদেশের খ্যাতিমান চলচিত্রকার ঋত্বিক ঘটক “তিতাস একটি নাম” চলচিত্র নির্মাণ করেন তখন দুই বাংলার বুদ্ধিজীবী মহলে সাড়া পড়ে যায়।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের শ্রষ্টা। শ্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে। তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস সৃষ্টি করে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। তাঁর সাহিত্য কর্ম শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও স্থায়ী আসন দখল করেছে।
সাহিত্য একাডেমি ১৯৮৩ সনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর খ্যাতিমান ব্যক্তিদের স্মরণে স্মরণ সভার মাধ্যমে পালন করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় সাহিত্য একাডেমি ১৯৯০ সন থেকে প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মদিনটি পালন করে আসছে। সাহিত্য একাডেমি অদ্বৈত’র নামে তাঁর জন্মভিটা গোর্কণঘাটের মল্ল পাড়ায় দিনব্যাপী মেলারও আয়োজন করেছে। যদিও তা অদৃশ্য শক্তির বলে বন্ধ হয়ে গেছে। কখনো তাঁর লেখা তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের নাট্যাংশ প্রদর্শন, কখনো আবৃত্তি, কখনো বা তিতাস একটি নদীর নাম চলচিত্র প্রদর্শন করেছে সাহিত্য একাডেমি। তার নেপথ্যে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন সাহিত্য একাডেমির উপদেষ্টা অধ্যাপক শান্তনু কায়সার। তিনি যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন তখন তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মণ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে থাকেন। তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মভিটা গোকর্ণঘাট যাতায়াত শুরু করেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণকে দেখেছে এমন একজন জীবিত ব্যক্তি রূপচান মল্লবর্মণকে তিনি খুঁজে বের করেন। মল্লপাড়ার বয়োবৃদ্ধ অদ্বৈত সমবয়সী রূপচান মল্লবর্মণ (বর্তমান প্রয়াত) বলেন, বালক বয়সে আমি অদ্বৈতকে দেখেছি। তখন তিনি স্কুলে লেখাপড়া করতেন। তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। দিনের বেলায় তিনি স্কুলে যেতেন, রাতে নদীতে মাছ ধরতেন। মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে হারিকেন জ্বালিয়ে লেখাপড়া করতেন। এসব আমি দেখেছি। এক সময় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। শুনলাম তিনি কলকাতায় লেখাপড়া করতে গেছেন আর ফিরে এলেন না।
অধ্যাপক শান্তনু কায়সার অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা কলকাতার দেশ পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত পত্রিকা সংগ্রহ করে দুই বাংলার মধ্যে তিনিই প্রথম অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনী রচনা করেন যা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক শান্তনু কায়সার বাংলা একাডেমি থেকে যা সম্মানী পেয়েছেন তা দিয়ে গোকর্ণঘাটের মল্ল পাড়ায় খিচুড়ি রান্না করে খাইয়েছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণ সম্পর্কে আরো কিছু করার জন্য তখন তিনি সাহিত্য একাডেমিকে বিভিন্ন পরামর্শ দিতে থাকেন। বিশেষ করে তাঁর জন্মদিন উদযাপন করা জন্য জোরালোভাবে প্রস্তাব করলে সাহিত্য একাডেমি প্রস্তাবনায় সম্মত হয়ে নিয়মিতভাবে তা উদযাপন করে আসছে। সাহিত্য একাডেমির আয়োজনে অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মদিবস উদযাপনে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অচিন্ত বিশ্বাস শান্তনু কায়সারের আমন্ত্রণে সাহিত্য একাডেমির অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তিনি এখান থেকে ফিরে গিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনা সমগ্র এক করতে লাগলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ, ছবি, দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাস, পুঁথিঘর প্রকাশিত তিতাস একটি নদীর নামসহ তা সংগ্রহ করেন। তখন তাঁর সাথে ছিলেন বাংলা বিভাগের ছাত্র শাহানা বসু। শাহানা বসু তখন অদ্বৈত মল্লবর্মণের ওপর (পিএইচডি) গবেষণা শুরু করেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণ কালচার এন্ড এডুকেশন ফাউন্ডেশনের সভাপতি সুশান্ত হালদার সাধারণ সম্পাদক রণবীর বিশ্বাস এসেছিলেন। ত্রিপুরা রাজ্যের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী অনীল সরকার, ননী গোপাল চক্রবর্তী ও কবি দিলীপ দাস বিভিন্ন সময়ে এসেছিলেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণকে গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন ময়মসিংহ ত্রিশালের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যপাক ড. সাহাবউদ্দিন বাদল, গবেষণা করছেন এড. মানিক রতন শর্মা।প্রেস বিজ্ঞপ্তি।
Leave a Reply