বিশেষ প্রতিবেদক//সময়নিউজবিডি
নিজের ও পরিবারের স্বপ্ন ছিলো ছেলে ডাক্তার হবে। করবে সাধারন মানুষের চিকিৎসা সেবা। স্বপ্ন পূরণের পথেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন মেডিকেল প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফ বিল্লাহ মামুন। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আগেই চলে যেতে হলো ওপারে। যেখান থেকে আর কোনদিন ফিরে আসবেন না।
বলছিলাম বিজয়নগরে নৌ-দূর্ঘটনায় নিহত গ্রীণ লাইফ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আরিফ বিল্লাহ মামুন এর কথা। তার বয়স হয়েছিল ২০ বছর।
গতকাল শুক্রবার (২৭ আগস্ট) বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার শেখ হাসিনা সড়কের লইছকা বিল সংলগ্ন নদীতে বালুবাহী ট্রলারের সাথে যাত্রীবাহী নৌকার সংঘর্ষে নিহত ২২ জনের মধ্যে একজন আরিফ বিল্লাহ মামুন।
গত ২২ আগস্ট ২০২১ ইং তারিখে সিলেট ভ্রমণে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তন্ময়ের সাথে নিহত আরিফ বিল্লাহ মামুন।
নিহত আরিফ বিল্লাহ মামুন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামের সৌদি প্রবাসী জহিরুল হক ভুইয়ার ছেলে ও হাজী ইসমাইল ভুইয়ার নাতি।
শনিবার (২৮ আগস্ট) দুপুরে মেধাবী মেডিকেল শিক্ষার্থী আরিফ বিল্লাহ মামুনের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পরিবার পরিজন ও প্রতিবেশীদের আর্তনাদে চিত্র। তবে ছেলের এমন করুণ মৃত্যুতে পাশে নেই বাবা-মা কেউই। বাবা সৌদিআরব প্রবাসী। মাও বর্তমানে রয়েছেন সৌদি আরবে। পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে দেশে (বাংলাদেশে) আসার পথে বিমান রয়েছেন আরিফ বিল্লাহ মামুন এর বাবা-মা।
বন্ধুদের সাথে সিলেট ভ্রমণে লাল তীর চিহ্ন নিহত আরিফ বিল্লাহ মামুন।
সৌদি প্রবাসী জহিরুল হক ভুইয়ার দুই সন্তানের মধ্যে আরিফ বিল্লাহ মামুন বড়। তার ছোট ভাই ফয়সাল বিল্লাহ (১২) স্থানীয় একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় হেফজখানায় পড়াশোনা করছেন।
নিহত আরিফ বিল্লাহ মামুনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় একটি লাশবাহী গাড়িতে বাবা-মা’র জন্য রাখা হয়েছে তার মরদেহ। এসময় কথা হয় আরিফ বিল্লাহ’র ছোট চাচা সৌদি প্রবাসী বোরহান ভুইয়ার সাথে। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, তারা তিন ভাইয়ের মধ্যে আরিফ বিল্লাহ মামুনের বাবা জহিরুল হক ভুইয়া সবার বড়। তিন ভাইয়ের যৌথ সংসারের মধ্যে আরিফ বিল্লাহ মামুন সবার বড় ও আদরের।
তিনি আরো জানান, ছোট বেলা থেকে আরিফ ছিলো সৌখিন ও মেধাবী। সে পড়াশোনায় ছিলো অত্যন্ত মনোযোগী। সে কারণে আমাদের পরিবারের লোকজন ছিলাম আশাবাদী। তার পড়াশোনার জন্য কোনো অবহেলা আমরা করিনি। যখন যা চেয়েছে আমরা তা দিয়েছি। তিনি বলেন, আরিফ পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে কৃতিত্বের সাথে সবগুলো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
বন্ধুদের সাথে ছবির মাঝখানে নিহত আরিফ বিল্লাহ মামুন।।
এসময় নিহত আরিফ বিল্লাহ মামুনের আরেক চাচা ওমর ফারুক ভুইয়া জানান, গত দুই মাস আগে রাজধানীর গ্রীন রোডের গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজে ভাতিজাকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন ও আশা নিয়ে ১৮ লাখ টাকা ভর্তি ফি দিয়ে ভর্তি করেন। গত ৬ মাসে আরো প্রায় ভাতিজার পড়াশোনার জন্য ১০ লাখ টাকা খরচ করেছি। আমাদের একটাই আশা ছিলো ভাতিজা ডাক্তার হবে। ভাতিজা বেঁচে থাকলে আরো ৫০ লাখ টাকা খরচ করলেও কোন দুঃখ থাকতো না। এ নৌ-দূর্ঘটনা আমাদের সব স্বপ্ন চূর্নবিচূর্ন হয়ে গেলো। মাটি চাপড়িয়ে কান্নাকাটি করতে করতে ওমর ফারুক আরো জানান, আমার ভাতিজা ইকরা প্রি-ক্যাডেট কিন্ডারগার্টেন থেকে পিএসসি, অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে কৃতিত্বের সাথে কুমিল্লার ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি করি। সেখান থেকেও গত ২০১৯ ইং সনের এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
সিলেট ভ্রমণে প্রিয় বন্ধু তন্ময়ের সাথে মেডিকেল শিক্ষার্থী আরিফ বিল্লাহ মামুন।
পরে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও বাবা-মা’র স্বপ্ন পূরণ করতে সে গত দুই মাস আগে গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। গত ২৬ আগস্ট সে তার মেডিকেল কলেজ থেকে করোনা ভ্যাকসিন গ্রহন করে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসেন। তিনি আরো জানান, গতকাল আমার ভাতিজা তার এক বন্ধুর কিছু কাগজপত্র নিয়ে জেলা শহরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আর আমাদের মাঝে ফিরে আসেনি। ফিরে এসেছে লাশ হয়ে।
গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজের পক্ষ থেকে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফ বিল্লাহ মামুনের মৃত্যুতে শোক বার্তা।
নিহত আরিফ বিল্লাহ মামুন এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহরিয়ার ইসলাম তন্ময় জানান, সে অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ ছিলো। সে বন্ধু পরায়ন একজন মানুষ ছিলো। বন্ধু-বান্ধবসহ সকল মানুষের প্রতি ছিলো তার গভীর মমত্ববোধ। তার মতো বন্ধু পাওয়া খুবই দুঃস্কর। তাকে হারিয়ে আমাদের বন্ধু মহলে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তন্ময় আরো জানান, গত ২২ আগস্ট আমরা ৭ বন্ধু মিলে সিলেটে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে এসেছি। আমরা এতো দ্রুত বন্ধুকে হারাবো তা ভাবতেই বুক ফেঁটে যাচ্ছে। আমরা এ নৌ-দূর্ঘটনার জন্য দায়ীদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।
আহসান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও আরিফ বিল্লাহ মামুন এর এ ঘনিষ্ঠ বন্ধু তন্ময় আরো বলেন, এইচএসসি পড়াশোনা চলাকালীন সময় এক সাথে ২ বছর ও গত ৩ বছর ঢাকা ফার্মগেইট এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এক সাথে থেকেছি। দুজন দুজনের সাথে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অনেক বিষয়ও একে অপরের সাথে শেয়ার করেছি। তন্ময় আরো বলেন, ওর (আরিফ বিল্লাহ মামুন) বাবা-মা কোন কারনে ওর ফোনে না পেলে আমাকেই কল দিয়ে খোঁজখবর নিতেন। তেমনি করে আমার বাবা মা’ও ওর কাছ থেকে আমার খোঁজখবর নিতেন। আরিফ বিল্লাহ মামুনের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তার ঘনিষ্ঠ এ বন্ধু আরো জানান, খবরটি শোনার পর থেকে এখনও পর্যন্ত খাবার ও বিছানার সাথে আমার শরীর লাগেনি। কোনভাবেই তার এ অবেলা চলে যাওয়াটা মানতে পারছিনা।
এদিকে, পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আজ শনিবার অর্থাৎ রবিবার রাত ৩ টায় নিহতের বাবা-মা বাংলাদেশে এসে পৌঁছবেন। আগামীকাল বাদ জোহর তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিহত আরিফ বিল্লাহ মামুনের নিতর দেহ।
উল্লেখ্য, গতকাল শুক্রবার (২৭ আগস্ট) বিকেল পৌনে ৬ টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার শেখ হাসিনা সড়কের লইছকা বিল সংলগ্ন নদীতে বালুবাহী ট্রলারের সাথে যাত্রীবাহী নৌকার সংঘর্ষ হয়। এতে যাত্রীবাহী নৌকাটি নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। এঘটনায় গতকাল শুক্রবার রাত পর্যন্ত ২১ টি মরদেহ ও আজ শনিবার সকাল পৌনে ১০ টায় এক শিশুসহ এ পর্যন্ত ২২ টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এঘটনায় আরো ২০/২৫ জন যাত্রী আহত হয়ে জেলা সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
ইনাম/সময়নিউজবিডি টুয়েন্টিফোর।
Leave a Reply