স্টাফ রিপোর্টার//সময়নিউজবিডি
হতদরিদ্র জাবেদের স্বপ্ন পূরণে পাশে দাঁড়ালেন মোঃ ফিরোজ মজুমদার নামে এক পুলিশ সদস্য। যার সহযোগিতা নিয়ে বন্ধ হয়ে পড়া মোঃ জাবেদের পড়াশোনা শুরু হয়। এতে নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে জীবন গড়তে রাতদিন পড়াশোনা করে যাচ্ছেন জাবেদ।
ব্রাহ্মণবাড়িযার বিজয়নগর উপজেলার ইছাপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের মৃত সায়েদুল ইসলাম ও মৃত রোমেনা বেগমের তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে জাবেদ সবার ছোট। মা রোমেনা বেগম মারা যায় ২০১৪ ইং সনের ফেব্রুয়ারি মাসে। তার বাবা সায়েদুল ইসলাম একজন শ্রমিক। তিন বোন বিয়ে স্বামীর সংসার করছেন আর দুই ভাই বিয়ে করে আলাদা আলাদা বসবাস করেন। ভাইয়েরা নিজেদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। ২০১২ সালে মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর নিজের খাবার জোগাতে পড়াশোনা বন্ধ করে ২০১৪ সনের এপ্রিল মাসে মির্জাপুর বাজারে মন্নর আলীর মুদির দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ নেয়। দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করাকালীন ২০১৫ ইং সনের ৮ জানুয়ারি বিজয়নগর থানায় পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে যোগ দেন মোঃ ফিরোজ মজুমদার নামে এক মানবিক পুলিশ সদস্য। যিনি প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে গিয়ে চোখ পড়ে হতদরিদ্র জাবেদের দিকে। পরে জাবেদের সাথে কথা বলে জানতে পারেন তার কষ্টের কথা? কেন বন্ধ হয়ে গেল তার পড়াশোনা? যা শুনে হৃদয় গলে যায় ফিরোজ মজুমদারের। পরে জাবেদের পড়াশোনা সহ সকল দায়িত্ব তুলে নিজ কাঁধে। শুরু হয় ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন পূণরায় সফল হতে চলে জাবেদের স্বপ্ন।গত ২০১৬ ইং সনে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বিদ্যানিকেতনে পুলিশ সদস্য ফিরোজ মজুমদার নিজ খরচে ৬ষ্ট শ্রেণীতে জাবেদকে ভর্তি করান। কথা বলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্য শিক্ষকের সাথে। সকল খরচ ফিরোজ মজুমদার নিজে বহন করবেন বলে শিক্ষকদের জানিয়ে বিষয়টি কারো সাথে না বলারও অনুরোধ করেন। একজন পুলিশ সদস্যের এমন মহানুভবতা দেখে অবাক হন স্কুলের শিক্ষকরা। এরই মাধ্যমে শুরু হয় জাবেদের নতুন জীবন। একজন পুলিশ সদস্য হিসেবে নিজের কর্মব্যস্ততার পরও সার্বক্ষণিক জাবেদের পড়াশোনার খোঁজখবর রাখেন তিনি। স্কুলের শিক্ষকদের কোচিং ক্লাসের পরও বাসায় আরো একজন প্রাইভেট শিক্ষক নিযুক্ত করা হয় জাবেদের পড়াশোনার জন্য।
পুলিশের এ হৃদয়বান সদস্যের সার্বিক সহযোগীতায় গত ২০১৭ সনে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বিদ্যানিকেতন থেকে জেএসসি পাশ করেন জাবেদ ও ২০২০ ইং সনে জাবেদ ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ফলাফলের অপেক্ষায় আছেন। এরইমধ্যে চলতি মার্চ মাসের ৮ তারিখ মানবিক এ পুলিশ সদস্য ফিরোজ মজুমদারের অন্যত্র বদলি হয়ে গেছে।
উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক রেজাউল ইসলাম জানান, দু’একজন পুলিশের সম্পর্কে সাধারন মানুষের খারাপ ধারণা থাকলেও অধিকাংশ পুলিশ সদস্যদের মধ্যেই মায়ামমতা ও মহানুভবতা আছে, যা আবারো প্রমাণ করলেন বাংলাদেশ পুলিশের বিজয়নগর থানায় কর্মরত মোঃ ফিরোজ মজুমদার। যিনি পুলিশের একজন কনস্টেবল হয়েও একজন হতদরিদ্র শিক্ষার্থীর পড়াশোনার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। যা পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে বলে আমি মনে করি। ফিরোজ মজুমদারের এ মহানুভবতা আমাদের কাছে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তিনি বলেন জাবেদ মিয়া পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার কিছুদিন পর তা মা মারা যান। এতে হতদরিদ্র জাবেদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। পরে স্থানীয় একটি মোদি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ নেন জাবেদ। সেখান থেকে ফিরোজ মজুমদার তার পড়াশোনা সহ সকল দায়িত্ব নিয়ে ৬ষ্ট শ্রেণীতে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বিদ্যানিকেত ভর্তি করান। তার সহযোগীতায় জাবেদ ২০১৭ সালে জেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০২০ সনের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।
এ বিষয়ে জাবেদ মিয়া জানান, ফিরোজ মজুমদার ভাই আমার কাছে দেবদূত হয়ে এসেছেন। আমি যে মোদি দোকানে কাজ করতাম সেখানে তিনি বিভিন্ন সময় কেনাকাটার জন্য আসতেন। একদিন আমার সাথে কথা হলে আমি উনাকে আমার পারিবারিক অবস্থা বললে তিনি জানতে চান আমার পড়াশোনা করার ইচ্ছে আছে কিনা। তখন আমার আর্থিক অক্ষমতার কথা বললেন তিনি জানান আমার পড়াশোনা সহ সকল খরচ তিনি বহন করবেন। পরে উনি আমাকে ” উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বিদ্যানিকেতন” নিয়ে গিয়ে ৬ষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি করান। উনার সহযোগীতায় আমি জেএসসি পাশ করি ও এবছর (২০২০ ইং) এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষাও ভালো হয়েছে। ফলাফলও ভালো হবে জানিয়ে ভাঙা গলায় কান্না করে এ প্রতিবেদককে জানান, যতদিন বেঁচে আছি ততদিন ফিরোজ ভাইকে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সাথে মনেপ্রাণে লালন করবো। কিন্তু ভাইতো বদলি জনিত কারণে অন্যত্র চলে গেছেন। পড়াশোনা শেষে কি করতে চাও জানতে চাইলে জাবেদ এ প্রতিবেদককে জানান, আমি মানুষের মতো মানুষ হতে চাই। আমি একজন ভালো পুলিশ হতে চাই, সবসময় যেন ফিরোজ মজুমদার ভাইয়ের মতো মানুষের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারি।
বাংলাদেশ পুলিশের বিজয়নগর থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্য মোঃ ফিরোজ মজুমদারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব। আমি যখন জানতে পারি ছেলেটি পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর তার মা মারা যায় ও আর্থিক অভাব অনটনের জন্য পড়াশোনা বন্ধ করে জীবন জীবিকার জন্য কর্মচারী হিসেবে মোদি দোকানে কাজ নেই। ঠিক সেই মূহুর্তে আমি জাবেদকে নিজের ছোট ভাই হিসেবে আমার চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে চিন্তা করলাম যদি সে আমার ছোট ভাই হতো তাহলে কি আমি তার পড়াশোনা বন্ধ করে অন্যের দোকানে কর্মচারী হিসেবে দিতে পারতাম না। সেই ভাবনা থেকেই আমি দুই-তিন রাত বিষয়টি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেই জাবেদের পড়াশোনার দায়িত্ব আমি নেব। আর সে ভাবনা মতো ঐ দোকান থেকে এনে আমার কর্মস্থল বিজয়নগর থানা সংলগ্ন মির্জাপুরে অবস্থিত উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বিদ্যানিকেতনে ৬ষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি করায়। পরে আমি আমার সাধ্যমতো তার পড়াশোনা সহ সকল প্রয়োজনে সহযোগিতা করে যায়। ইতিমধ্যে ২০১৭ ইং সনে সে জেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এবছর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। এরইমধ্যে চলতি মার্চ মাসের ৮ তারিখে আমার অন্যত্র বদলি হয়ে যাওয়া আমি বেশ দুঃচিন্তাই পড়ে গেলাম। তিনি বলেন, পুলিশের চাকুরী মানেই সারাক্ষণ ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হয়। যে কারণে তার খোঁজখবর নিয়মিত নেয়াও সম্ভব হবে না। তাহলে কি তার লেখাপড়া আবারও বন্ধ হয়ে যায় কিনা। এমন ভাবনাই ঘুরপাক করছে মনে। যদি কোন সুহৃদয়বান ব্যক্তি এই গরীব ছেলেটির বাকী পড়াশোনার দায়িত্ব নিতেন তাহলে আমার সহযোগিতাটা পরিপূর্ণ হতো। তবে আমি যেখানেই থাকি জাবেদের সাথে যোগাযোগ থাকবে এবং সাধ্যমতো সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আমার বিশ্বাস আল্লাহ পাক কাউকে না কাউকে তার (জাবেদের) সহযোগীতায় পাঠাবেন।
উল্লেখ্য, কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার দাউভান্ডার গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য হানিফ মজুমদার ও কামরুন্নেহার এর চার মেয়ে ও একমাত্র ছেলে ফিরোজ মজুমদার।ফিরোজ মজুমদার ২০১৩ ইং সনের ২৭ মার্চ বাংলাদেশ পুলিশের একজন কনস্টেবল হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২০১৫ ইং সনের ৮ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানায় এসে যোগদান করেন। দীর্ঘ ৫ বছর ২ মাস অত্যন্ত স্বনামের সহিত দায়িত্ব পালন করেন ফিরোজ মজুমদার। গত ৮ মার্চ ২০২০ ইং তারিখে তিনি অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত ও এক কন্যা সন্তানের জনক।
ইনাম/সময়নিউজবিডি টুয়েন্টিফোর।
Leave a Reply