বেশীরভাগ সময় কাটছে চার দেয়ালের ভেতর। গোটা বিশ্বের মতোই, চির চঞ্চল জীবনাচারে অর্ভতপূর্ব থমকে যাওয়া। এরিমাঝে জরুরী পেশাগত কারণে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি, ভিন্ন দৃশ্যপট যা কখনো দেখিনি আগে। দিনের বেলা নীরব পথে হেঁটে যাচ্ছি, পাড়ার মোড়ে যেতেই দেখি রহমত, রিক্সা নিয়ে একা দাঁড়িয়ে। আগে মাঝে মধ্যে মোটর বাইক ছাড়া দেখলেই রহমত আমাকে এগিয়ে এসে রিক্সায় তুলে নিতো , বলতো, “গাড়িটা কি নস্ট? গন্তব্যে পৌছিয়ে বলতো, “থাক ভাড়া লাগতো না, আপনি যে আমার রিক্সায় উঠছেন এতেই খুশী।” সামান্য বাইক নষ্ট হওয়াতে রহমতের সহমর্মিতায় আমার প্রতি তার আন্তরিকতায় অবাক হয়ে জোর করে তাকে ভাড়া দিতাম , কত দিয়েছি সে কোনদিন আমার সামনে গুণে নেয়নি। আজ রহমত মোটর বাইক নষ্ট কিনা জানতে চাইলো না। রিক্সায় উঠিয়েই সোজা প্রশ্ন ,“ মামু আর কদিন ?”আমি তাকিয়ে আছি রহমতের মুখের দিকে, তেল চকচকে, শ্রমের ঘামের জৌলুশ তার নেই,ঠোঁটগুলো শুকনো, চাহনী দূর্বল। আগে ওর রিক্সায় উঠলে তার যে চাঞ্চল্য দেখতাম তাও খুজি পাইনা। আগে রসাল নানা রকমের কথায় দ্রুতই গন্তব্যে পৌছে যেতাম, আজ দেখি প্যাডেলে তার পা ধীর, হ্যান্ডেলে হাত কাঁপছে। রিক্সায় উঠলে আমি চুপ থাকি না কোন সময়, চালকের সাথে এটা ওটা জানা প্রশ্ন ইত্যাদী পুরনো অভ্যেস। আজ দেখি আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুচ্ছে না। রহমতেরই প্রশ্ন, “করোনা কি শেষ হইবো না ”? আমি চুপ। রহমত একাই বলে যাচ্ছে,“ ৭ দিন রিক্সা চালাই নাই। কামের মানুষ, ঘরে কত বইস্যা থাকুম, ঘরে বইস্যা খুব কাছ থেইক্যা কষ্ট দেহন লাগে, তিনডা ছোট বাইচ্চা, বাপেরে কাছে পাইয়া হেরা খুশী, এইডা ওইডা চায় বারবার,মজা খামু কইলে, বারবারই আইন্যা দিমু আইন্যা দিমু কই। বউ চাইয়া থাহে মুহের দিগে, ঘর চাউল নাই, ডাইল নাই একথা তার কওন লাগে না, মুখ দেখলে বুঝি। পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া দেহি নাই বউয়ের, খুব কাছে বইয়া দেখছি, দেখছি হে আল্লাহর কাছে হাত তুইল্লা শুধু কান্দে,নামাজ শেষ কইরা আঁচলে চোখের পানি মুইচ্যা জিগায়, আর কদিন ? আমি উত্তর না দিয়া ঘর থাইক্যা বাইর হইয়া আসমানের পাইল চাইয়া থাহি। আজকা কিছু না নিলে উপাস থাকতে হইবো, হের লাইগ্যা বাইর হইছি।” রহমত একাই বলছে, আমি চুপ। আবার প্রশ্ন রহমতের , মামু আর কদিন ? আমি চুপ আর বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। রহমতের প্রশ্নের জবাব যে আমারও জানা নেই। গন্তব্যে পৌছে পকেটে যা ছিল তা দিয়ে বল্লাম,মরণ থেকে নিজে বাচতে হলে, পরিবার পরিজনকে বাঁচাতে হলে,অন্য সবাইকে বাঁচাতে হলে সহ্য করতে হবে ততদিন যতদিন ভাইরাস না শেষ হয় । মহান আল্লাহ সহায়। প্রেস ক্লাবে বসতে ভাল লাগলো না। আমার মনে রহমতের প্রশ্ন আর তার দিনযাপনের চিত্র তার র্দুদিনের কষ্ট। এমন রহমত একা নয় অনেক। প্রতিদিন কর্ম করে যাঁদের জীবন চলে, একদিন কাজ না করলে যাঁদের সংসার অচল, বেঁচে থাকার জন্য জীবনের নুন্যতম প্রয়োজন মেটাতে একবেলা খাবারের জন্য যাঁরা গা খাটায় তাদের সংখ্যা অনেক। মনে কষ্ট জমা হলে কবিতার শরনাপন্ন হই, কবিতা আবৃত্তি করি নিজে নিজে। আজ অন্য কোন কবিতা মনে হচ্ছে না, এলোমেলো লাইনে সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাই মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, কবি যেন বলছেন–“হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলিতোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,এসেছে শুভদিন,দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!”আজ আবৃত্তি করতে গিয়ে দেখি কবিতার লাইনও এলোমেলো, কবিতার আসল উদ্দেশ্যটাই মনে ধ্বনীত হচ্ছে। যাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দীর্ঘদিন আমাদের আরাম দিয়েছে,আমাদের প্রাসাদ গড়েছে, আমাদের মালের বোঝা, শরীরের ভার বয়ে আমাদের ঋণী করেছে আজ তাদের দুর্দিন, এমনই দুর্দিনের সময়কে ঋণ শোধের সুযোগ মনে করে আজ শুধু মনে একই আহবান,আসুন, আমাদের ভার এতদিন যাঁরা বয়েছে, আমার সুবিধার জন্য মাথার ঘা পায়ে ফেলেছে, তাঁদের জীবন চলার অন্তত কদিন খাবারের ভারটা আমরা বহন করি। আশে পাশে দৈনিক রোজাগারী শ্রমজীবিদের খোঁজখবর রাখি, সমাজের সামর্থবান আছেন যাঁরা, সহর্মমিতায় তাঁদের পাশে দাঁড়াই।
লেখক : সিনিয়র সহসভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব,০১৭১১১০১৬৪২। তারিখঃ ০২-০৪-২০২০ ইং।
Leave a Reply