পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। চারদিকেই এখন পয়লা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ পালনের ঘনঘটা। যদিও বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে এবারও হচ্ছে না মঙ্গল শোভাযাত্রা সহ পয়লা বৈশাখকে ঘিরে অন্যান্য উৎসবমুখরতা। তথাপিও নানান বাতাবরণে দিবসটি পালন হবেই। কেননা, আমরা এখন কেবলই উৎসব পালন করা নিয়েই ব্যস্ত। কিন্ত এর শুরু কখন? সেই ইতিহাস কি আমরা জানি? জানতে চাই? বাংলা সন প্রবর্তিত হয় ভারতবর্ষে। আর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন মোঘল সম্রাট আকবর, এর বিনির্মাতা চিন্তক হলেন ফতেহ্ উল্লাহ সিরাজী। তাদের কি আমরা কদ্যপিও স্মরণ করি-করতে চাই?
-মহামতি আকবর। আকবর দ্যা গ্রেট। যে নামেই ডাকা হোকনা কেন, তিনি হলেন মোঘল সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। তিনি ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট। ভারতের মোঘল সাম্রাজ্য তথা মোঘল বংশের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর ওরফে বাদশাহ্ বাবর এর দৌহিত্র। অপরদিকে তিনি মোঘল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সম্রাট হুমায়ুন এর পুত্র। আর এই আকবরের শাসনামলেই ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ থেকে বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু হয় ।-সম্রাট আকবরের একান্ত ইচ্ছাতেই তৎকালীন বাংলার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তক ফতেহ্ উল্লাহ সিরাজী বাংলা সনের নিয়মানুবর্তিতা তৈরি করেন। নতুন করে প্রবর্তিত এই বাংলা সনে ‘সৌরবর্ষ’ বা খ্রিষ্টীয় সন এবং ‘চান্দ্রবর্ষ’ বা আরবি বা হিজরি সনের উপর ভিত্তি করা হয়।
তাছাড়া সম্রাট আকবরের মসনদে আরোহণকাল চান্দ্র সন ৯৬৩ হিজরিকে সৌর গণনায় আনা হয়। সৌর এবং চান্দ্র এই দু’টি সনের উপর নির্ভর করে বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়। বাংলা সন সৌর কেন্দ্রিক ছিলো বলেই সপ্তাহের বারের নামগুলোও রাখা হয় সৌর বলয়ের সঙ্গে মিলিয়েই। যেমন- মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রবি ইত্যাদি।-মূলত সৌর পঞ্জিকা কেন্দ্রিক এবং কৃষকের উৎপাদিত ফসলের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ৩০ শে চৈত্র বকেয়া খাজনা পরিশোধের দিন ধার্য্য করার লক্ষ্যেই বাংলা নববর্ষের প্রবর্তন করা হয়। চৈত্র মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে যেসব কৃষকেরা তাদের বাৎসরিক বকেয়া খাজনাদি পরিশোধ করতে সক্ষম হতেন,পরদিন তাদেরকেই অত্যন্ত সাদরে আপ্যায়ন করা হতো। এ দিনটিই হচ্ছে পহেলা বৈশাখের উৎসব। আগের বছরের খাজনা আদায় করতে সক্ষম কৃষকদেরকে এই দিনটিতে মিষ্টান্ন পরিবেশনের মাধ্যমে করা হতো আপ্যায়ন। আর সেই সাথেই পরবর্তী আরো এক বছরের জন্য সেই সফল কৃষকদের মাঝে নতূন করে দেয়া হতো জমির বন্দোবস্ত।-সময়ের সাথে পাল্লা দিয়েই এগুতে থাকে বিশ্ব। এরই ধারাবাহিকতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল উৎকর্ষতায় মানুষের জীবনধারায় পরিবর্তন যেন এক চলমান প্রক্রিয়া। আর তা কদ্যপিও থেমে নেই, কেবলই গতিশীল। ঠিক তেমনি গতিধারায় কৃষি নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় ক্রমেই বিকাশ ঘটতে থাকে শিল্পের। প্রসার ঘটে ব্যবসা-বাণিজ্যের। কৃষিকাজের পাশাপাশি ব্যবসাতেও মনোনিবেশ করে বাঙালিরা। কিন্তু তাই বলে বাঙালি তার নিজ ঐতিহ্যকে ছাড়েনি কিছুতেই। চৈত্র মাসের শেষের দিনটিতে যেমনি করে কৃষকদেরকে সারা বছরের বকেয়া খাজনা আদায় করতে হতো, তদ্রুপ এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন ব্যবসাতেও। সারা বছরের বকেয়া আদায়ের কৌশলগত আরেকটি উপায় বের করে। এইক্ষেত্রে বকেয়াদারদের সম্মানে নিমন্ত্রণপত্রের মাধ্যমে আয়োজন করা হয় এক অনুষ্ঠানের। পরিবেশন করানো হয় মিষ্টান্ন। এই আনন্দে তারাও বকেয়া মিটিয়ে ফেলতে হন উদ্বুদ্ধ। একেই বলা হয় ‘হালখাতা’ উৎসব।-এখন বিশ্বায়নের যুগ। সেই রাজা-জমিদার আজ আর নাই, জমিদারিও নাই; ঘটা করে খাজনা পরিশোধের ঝামেলাও নেই।অাবার সেই ব্যবসা-বাণিজ্যের হালখাতা অনুষ্ঠানও আজকাল তেমনটি নাই। তবে থেকে গেছে বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি বাংলা নববর্ষ গণনা আর বর্ষবরণ উৎসব। এক কালের খাজনা পরিশোধের দিন- পরবর্তীকালের হালখাতা অনুষ্ঠান এসব ঘিরেই আজ রূপ নিয়েছে অসম্প্রাদায়িক বাঙালিদের প্রাণের আনন্দ উৎসবে। একজন বাঙালি হিসেবে আমিও এই উৎসবের অংশীদার। সকলকে জানাই বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন।
লেখক- এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, পাঠাগার ও ক্রীড়া সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।
Leave a Reply