সংবাদ শিরোনাম
নবীনগরে পুকুর থেকে অজ্ঞাত শিশুর মরদেহ উদ্ধার কমলগঞ্জে ‘পার্টনার ফিল্ড স্কুল কংগ্রেস’ নানা কর্মসূচিতে কমলগঞ্জে গুড নেইবারস এর পরিচ্ছন্নতা অভিযান ঢাকাস্থ চম্পকনগর ইউনিয়ন সমিতি গঠনের লক্ষ্যে পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত কমলগঞ্জে ৬ দফা দাবিতে স্বাস্থ্য সহকারীদের দুই ঘন্টা অবস্থান কর্মসূচি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিটিজেএ সভাপতিরসহ পরপর তিন টিভি সাংবাদিকের মোটরসাইকেল চুরি কমলগঞ্জে স্কাউটের ব কাব কার্নিভাল ২০২৫ কমলগঞ্জে অভিভাবক -ছাত্র -শিক্ষক সমন্বয় সভা লালমনিরহাটে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে বাবা-ছেলে আটক বিজয়নগরে পুকুর দখলকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষ।। আহত- ৭।। একজনে হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন
জয়তু নজরুল, ক্ষমিও মোদের ভুল- এইচ.এম. সিরাজ 

জয়তু নজরুল, ক্ষমিও মোদের ভুল- এইচ.এম. সিরাজ 

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ। নজরুল জয়ন্তী। আর যাই হোক, অন্তত এই একটি কারণেই আজকের দিনটি ঐতিহাসিক। আজ প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মবার্ষিকী। শতাধিক বছর আগে, ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ মোতাবেক ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে তারিখেই তিনি জন্মেছিলেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মালেও তিনিই আমাদের জাতীয় কবি। যদিও ‘নজরুল আমাদের জাতীয় কবি’ কথাটি কেবলই মৌখিক, দালিলিক নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে পাঁচ বছর বেঁচে-বর্তে থাকান্তে জীবনাসান ঘটার চার দশক অতিক্রান্তের পরও কবি নজরুলকে আমাদের জাতীয় কবির দালিলিক প্রমাণ দিতে না পারাটা আমাদেরই ব্যর্থতা-লজ্জা। পিতা কাজী ফকির আহমেদের ঔরষে এবং মাতা জাহেরা খাতুনের জঠরে জন্মানো সেই ‘দুখু মিয়া’-ই দ্রোহ ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
হয়তোবা তেমন হাকডাক নেই। তথাপিও আজ জাতীয় কবির জন্মদিন। বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এবারও সাড়ম্বরে দিবসটি পালনে গৃহিত হয়নি তেমন কোনোরকমের কর্মসূচি। ব্যক্তি জীবনেও কবি নজরুল আমৃত্যুই ছিলেন জাতীয় জাগরণেরও অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। আমাদের এই বাংলাদেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক কবি নজরুলকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে নিয়ে আসা, নাগরিকত্ব প্রদান, এমনকি কবির অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে কবিকে সমাহিত করা ইত্যাকার কর্মাদি করা হয়েছে।কিন্তু বড্ড পরিতাপের বিষয়, কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের ‘জাতীয় কবি’ এ বিষয়ে আজ অবধি কোনো সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এমনটি আমার অন্তত অজানা! কেবলই মুখে মুখে আর কালির আঁচরে লেখাতেই তিনি আমাদের ‘জাতীয় কবি’! অথচ সরকারি নথিপত্রে তিনি আজ অবধি আমাদের জাতীয় কবি নন! কেন?? এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের এতোগুলো বছর লাগছেই-বা কেন??? এহেন দৈন্যতার দায়ভারটা খুবই পীড়াদায়ক।
  ” আমায় নহে গো- ভালোলবাসো শুধু, 
    ভালোবাসো মোর গান।
   বনের পাখিরে কে চিনে রাখে- গান হলে অবসান! ”   
কারই-বা সাধ্য এমনটি রচিবার? আজন্ম ক্ষ্যাপাটে ছাড়া কি আর কারো কাছে এমনটি আশা করা যায়? সেই আজন্মকালের ক্ষ্যাপা-কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ধূমকেতু’ নামে খ্যাত কবি নজরুল তাঁর গীতবার্তায় অনেকটা এমনটিই বলে গিয়েছিলেন। তিনি সত্যিই জানতেন, চলে গেলে কতো আর পাবেন! যিনি আজীবন গোটা জাতিটাকেই স্বাধীনতার মন্ত্রে করে গেছেন উজ্জীবিত, আমৃত্যু কাটিয়ে গেছেন সংগ্রামে, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দেবার প্রয়াশে জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ দূরীভূতের কঠিন সংগ্রামে ঝাঁপ দিয়েছিলেন – তাঁর তো সেই একটা দিনই জাতির কাছে পাওনা। আর তা হলো ১১ই জ্যৈষ্ঠ। রীতিমতো বকতালীয়ই বটে,এবার দু’দিক দিয়েই দিনটি মিলেমিশে হয়ে গেছে একাকার। সেবার যবে তিনি এই ধরাধামে এসেছিলেন, সেদিনও ছিলো এমনই ১১ জ্যৈষ্ঠ ও ২৫ মে। একশ’ একুশ বছরের মাথায় এসে হুবহুই মিলে গেলো বঙ্গাব্দ আর খ্রিস্টাব্দের হিসেব! যাক তবুও কবি নজরুল চিরতরেই বাঙালির, জয়তু নজরুল।
কবি নজরুল ‘দ্রোহের কবি’ হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত হলেও তিনি প্রেম, মানবতাবাদ, সাম্য, মুক্তি আর বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়েই লড়ে গেছেন আমৃত্যু। তিনি আসলে কী করেন নি? ল্যাটোর দলে গান গাওয়া, রুটির দোকানে চাকরি করা, জনসভায় বক্তৃতা দেওয়া, কিশোর-যুবাদেরকে নিয়ে আড্ডায় মাতোয়ারা হওয়া, সৈনিক হয়ে যুদ্ধে যাওয়া, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করা, জেলে গিয়েও মুক্তি আদায় করা, গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে অসহায়দের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা এমন কোন্ কাজটি তিনি করেন নি? আর তাইতো তিনি আমাদের জাতীয় কবি।
“আমি তাহাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা।”
আসলেও ঠিক তাই-ই। তিনি তাহাই করেছেন, যাহাতে আসে মানবতার মুক্তি। সদায়ই তিনি গেয়েছেন মুক্তির জয়গান, ভাঙ্গার গান। কোনোরকমের শাসন-ত্রাসনই তাঁকে একটুও দমিয়ে রাখতে পারেনি। কেননা, তিনি তো ছিলেন সকল নিয়ম ভাঙ্গার এক মহা ওস্তাদ। কোনো রকমের নিয়মের বেড়াজাল-ই তাঁকে আটকাতে পারেনি। কারণ তিনিই লিখেছেন-
                ‘আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী
                 আমি রণদা সর্বনাশী
                আমি জাহান্নামের আগুণে বসিয়া
                              হাসি পুষ্পের হাসি।’
যৌবনের কিছুকাল তিনি কাটিয়েছেন কুমিল্লায়। রাণীর দীঘির পাড়ে, ভিক্টোরিয়া কলেজ অঙ্গনটায় জমাতেন নিয়মিত আড্ডা। আমার সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হলো স্মৃতিচিহ্ন করে রাখা সেই আড্ডাস্থলটি। দুইটি স্টোনে খোদাইকৃত লেখার পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ছবি ধারণ করারও সুযোগ ঘটেছে বলে আমি ধন্য- আপ্লুত। স্টোনে লেখা রয়েছে ‘কুমিল্লায় থাকাকালীন সময়ে (১৯২১-১৯২৩ খ্রি.) কাজী নজরুল ইসলাম প্রায় প্রতিদিনই এখানে বসেই কলেজ পড়ুয়া তরুণদের নিয়ে কবিতা-গানের আসর জমাতেন।’ তাঁর ‘মাধবী লতা দোলে—– এবং আরো কয়েকটি গান ঠিক এখানটাতেই রচিত। প্রেমিক নজরুল এইখানে বসেই তাঁর প্রেমিকা-প্রিয়তমা প্রমিলা দেবীকে চিঠি লিখতেন। কবিতার ছন্দেভরা সেসব চিঠি নজরুলের সুহৃদদের মাঝেও আনন্দের সঞ্চার করতো।
“তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি- আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর ও কুৎসিতের সাধনা আমার নয়।আমার আঘাত বর্বরের এমনকি কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামীই জানেন (তুমি কি জানো বা শুনেছো জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই।”
এটি কবি নজরুলের পত্রাংশ। বিচ্ছেদ ঘটার সুদীর্ঘ ১৫ বছর পর প্রথম এবং শেষবারের মতো নার্গিসকে লেখা এক পত্রে উপরোক্ত কথাগুলোই লিখেছিলেন কবি নজরুল। কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের সৈয়দা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন কবি নজরুল। সৈয়দা খাতুনের নাম রেখেছিলেন নার্গিস আসার খানম। তবে এই বিয়েটির পেছনে ছিলো আলী আকবর খানের সূক্ষ্ম বাণিজ্যিক কার্যক্রম! আর এমনটি বুঝেছিলেন বলেই নার্গিসের সাথে আয়োজিত বাসর থেকেই পালিয়েছিলেন কবি নজরুল।দৌলতপুরে কবি নজরুলের স্মৃতি মুছে যায়নি, বরং বেড়েছে। আমার এক পরম প্রিয়জনের অনুপ্রেরণায় আমাকে এই দৌলতপুর যেতে হয়েছে বহুবার। গিয়ে বুঝেছি, কেনই-বা দৌলতপুর গ্রামটি ‘কবিতীর্থ দৌলতপুর’ নামেও পরিচিত। যেই ঘরটিতে সাজানো হয়েছিলো কবি নজরুল-নার্গিসের বাসর, সেই ঘরটির সামনে স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতিফলক। এর পার্শ্ববর্তী আরেকটি ঘরে আজও স্মৃতি করে রাখা হয়েছে কবি নজরুল ও নার্গিস খানমের বাসর’র জন্য সাজানো ঐতিহ্যমণ্ডিত সেই পালঙ্ক। নার্গিসদের বাড়ির দক্ষিণের  পুকুরপাড়ের আম্রতলায় বসেই একদা কবি রচেছিলেন তাঁর বিখ্যাত একখানি কবিতা। সেই আম্রতলার অবয়ব ন্যায় একটি বেদি এবং পাশেই স্থাপিত ‘পাপড়ি খোলা’ স্মৃতিফলক কবি নজরুলের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। এর খানিক দক্ষিণের মাঠে নজরুল মঞ্চ। এসব মিলিয়ে দৌলতপুর যেনো কবি নজরুলেরই গ্রাম। আর এজন্যই গ্রামটি ‘কবিতীর্থ দৌলতপুর’ নামেও সমধিক পরিচিত।
“কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের’র। আমি ও দু’টোর কোনটাই না, আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যাণ্ডশেক করিয়ে গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি মাত্র।”
-এই লেখায় তিনি আসলে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন? তিনি কী সাম্প্রদায়িক নাকি সমাজের আর দশজনের চাইতেও অনেক গুণ বেশি অসাম্প্রদায়িক? তথাপিও কাজী নজরুলে প্রতি আমাদের মনের দৈন্যতা যেন আজও গেলোই না!
        ‘গাহি সাম্যের গান-
         মানুষের চেয়ে কিছু নাই,
          নহে কিছু মহীয়ান,
          নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ,
          অভেদ ধর্মজাতি
          সব দেশে সব কালে,
          ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে নজরুলের প্রাণান্তকর সংগ্রাম, সাম্য ও মুক্তির বাণী বর্তমান প্রেক্ষাপটে আরো অনেক বেশিই প্রাসঙ্গিক। পরিশেষে কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতির প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন এবং নিজের প্রতি অনেকটা ধিক্কার জানিয়ে শুধু দু’টো লাইন উচ্চারিত করতে চাই, যদিও আমি নই কবি।
          ‘আমার একবুক কষ্ট এই ব্যাটাকে নিয়ে
           তাঁর সবই নিলাম তাঁকেই কিছু না দিয়ে!’
——ক্ষমা করিও মোদের ভুল, জয়তু নজরুল।
এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, পাঠাগার ও ক্রীড়া সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব।

সংবাদটি পছন্দ হলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © 2017 Somoynewsbd24.Com