বিশেষ প্রতিবেদক//সময়নিউজবিডি
পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করা, খাবার-দাবারে অনিয়ম ও স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে দিনদিন হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। আর এ রোগের চিকিৎসা হিসেবে বাইপাস ও রিং এর ব্যবহার করে আসছেন চিকিৎসকরা। অনেক ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতার ফলে বাইপাস করানো সম্ভব হয়ে উঠে না। এতে একজন রোগী মৃত্যু শয্যায় চলে যায়। এর জন্য বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর গবেষণা শুরু করেন ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের চেন্নাইয়ের বাসিন্দা বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ বি আইয়াজ আকবর। অবশেষে তিনি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিও আবিষ্কার করলেন। পাশাপাশি তিনি তা বিভিন্ন রোগীদের উপর প্রয়োগ করে সফলতাও পেয়েছেন।
বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে সময়নিউজবিডি টুয়েন্টিফোর ডটকম এর এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ আইয়াজ আকবর এর সাথে। তিনি জানান, প্রতিরোধমূলক কার্ডিওলজিস্ট যিনি সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোর্স সম্পন্ন করেছেন। তিনি অস্ত্রোপচারের ট্রমায় থাকা রোগীর বিকল্প চিকিৎসার উপায় খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন। যাতে রোগীর চিকিৎসা এমনভাবে করা হবে যাতে রোগীকে অস্ত্রোপচারের মুখোমুখি হতে না হয়। এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কোন দূর্ভোগের শিকার হতে না হয়। সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে তিনি এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং নন-ইনভেসিভ চিকিৎসার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা এবং কৌশল সংঘটিত করার মাধ্যমে একটি যুগান্তকারী পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। পাশাপাশি তিনি এটাকেই তাঁর জীবনের লক্ষ্য করে গড়ে তোলেন। এভাবেই ২০০০ সালে তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজধানী চেন্নাইয়ে “অক্সিমড হাসপাতাল” নামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ হাসপাতালে রিং ও বাইপাস সার্জারি বিহীন চিকিৎসার সূচনা করেন।
চিকিৎসা বিপ্লবের এ সফল চিকিৎসক আরো জানান, এ পর্যন্ত তাঁর এ হাসপাতালে ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কুয়েত, ওমান, সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য রোগীরা হার্টের চিকিৎসা করেছেন এবং এতে ব্যাপক সফলতাও পেয়েছেন। মধ্যে কোভিড-১৯ এর কারনে বিদেশি রোগীরা ভিসা জটিলতা ও বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় বিদেশি রোগীরা আসতে পারেননি। তবে কোভিড পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হওয়ায় বিদেশি রোগীরা আসতে শুরু করেছেন।
তিনি জানান, হার্টের ব্লক সনাক্ত করার পর কয়েকটি থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে-
ইইসিপি।
এনহ্যান্সড এক্সটার্নাল কাউন্টার পালসেশন (ইইসিপি)- এ চিকিৎসাটির জন্য বড় আকারের বিপি কাফের মত পট্টি দুই পায়ে বাঁধা হয় এবং হৃদ-চক্রে হৃদপিণ্ডের রিল্যাক্সেশনের সময়ে সেগুলি স্বাভাবিক রক্তচাপের ২.৫ গুণ বেশী ফোলানো হয়। এটা হৃদপিণ্ডে রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধি করে এবং তার ফলে নতুন ছোট ছোট রক্তবাহী জালিকা বা ক্যাপিলারি তৈরি হয় (কোল্যাটারালাইজেশন) (নিও ভাস্কুলারাইজেশন)। এই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। এর ফলে কোনও রক্তপাত, ক্ষত, ব্যথা বা ট্রমা হয় না। এই চিকিৎসাটির সময় বা সেশন ১ ঘন্টা, যা কমপক্ষে ৩৫ বার দেওয়া হয়। তবে এই থেরাপিটি দিনে একবার বা সর্বোচ্চ দুইবার দেওয়া যায়। তার মানে ৩৫ টি ইইসিপি দিতে (দিনে দুইবার করে দিলে) সময় লাগবে প্রায় ১৮ দিন।
আর্টারি ক্লিয়ারেন্স থেরাপি (এসিটি)- কিলেশন থেরাপি সারা দেহে রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধি করে, এতে স্বাস্থ্যের অবস্থা উন্নত হয়। এই চিকিৎসার সাহায্যে অস্ত্রোপচার ছাড়াই ব্লক অপসারণ করা সম্ভব। এবং এটি একজন রোগীর জন্য অনেক উপকারী। এই চিকিৎসায় ইথিলিন ডায়ামিন টেট্রা অ্যাসেটিক অ্যাসিড (ইডিটিএ) ইন্ট্রাভেনাস ইনফিউশনের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। যা দেহ থেকে বিষাক্ত ধাতু অপসারণ করে এবং ক্যালসিয়াম ও কোলেস্টেরল বিপাকীয় ক্রিয়াও উন্নত করে।
ওজোন থেরাপি- ওজোন একটি প্রাকৃতিক উপাদান যা আমাদের বায়ুমন্ডলে পাওয়া যায়। এটি অক্সিজেনের তিনটি পরমাণু নিয়ে গঠিত। ওজোনের মেডিকেল রূপটি অক্সিজেন এনার্জাইজেশন করার মাধ্যমে তৈরি করা হয় এবং ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের আক্রমণের চিকিৎসার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এই চিকিৎসা টিস্যু বা কলা পরিস্কার করে এবং সেগুলিকে পুষ্টি জুগিয়ে রোগীকে সুস্বাস্থ্য ফিরে পেতে সাহায্য করে।
হাইপার বেরিক অক্সিজেন থেরাপি (এইচবিওটি)- হাইপার বেরিক অক্সিজেন থেরাপিতে উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপে রোগীকে অক্সিজেন সাপ্লিমেন্টেশন প্রদান করা হয়। চিকিৎসা চেম্বারের চাপ সমুদ্র স্তরের চাপের থেকে বৃদ্ধি করা হয় এবং কিছুক্ষণ বাদে বাদে রোগী বিশেষ মুখোশ, হুড এবং এন্ডোট্র্যাকিয়াল টিউব ব্যবহার করে ১০০% অক্সিজেনে শ্বাসগ্রহণ করেন।
অপরদিকে, এইচবিওটি ক্ষত দ্রুত সারাতে (ডায়াবেটিসের রোগীর ক্ষত, দূর্ঘটনায় হওয়া ক্ষত, গ্যাংগ্রিন ইত্যাদি) এবং রেডিয়েশনের ফলে হওয়া জটিলতার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। এটি কোনও স্পষ্ট কারণ ছাড়া হঠাৎ করে শ্রবণশক্তি হারানো এবং নিউরো-রিহ্যাবিলিটেশনের (মাথায় আঘাত, স্ট্রোক, মেরুদণ্ডে আঘাত ইত্যাদি) ক্ষেত্রেও উপযোগী। এটি শরীরের অঙ্গ পুনরুজ্জীবিত করা, রোগ প্রতিরোধ করা, সুস্থ থাকা এবং জীবনের গুণগত বজায় রেখে তাকে দীর্ঘায়ত করার জন্যেও মানুষ ব্যবহার করতে পারে।
এদিকে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজধানী চেন্নাইয়ের আন্নাশালাইর নন্দনাম এলাকায় অবস্থিত ” অক্সিমেড হাসপাতাল” এ চিকিৎসা করতে আসা বাংলাদেশী নাগরিক ও স্কুল শিক্ষক মোসাঃ হেনা আক্তার এ প্রতিবেদককে জানান, ২০২১ ইং সনের সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ করেই বুকে ব্যথা শুরু হয়। পরে দেশে বিভিন্ন টেস্ট করে প্রাথমিকভাবে হার্টের সমস্যা জানতে পারি। পরে এনজিওগ্রাম করলে চিকিৎসকরা জানান দুটি ব্লক আছে, যেখানে দ্রুত রিং বসাতে হবে। এ অবস্থায় পরিচিত একজনের কাছ থেকে অক্সিমেড হাসপাতালের সন্ধান পেয়ে এখানে চিকিৎসা করতে আসছি। এই হাসপাতালের থেরাপি চিকিৎসায় বর্তমানে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো কোন রিং ও সার্জারি ছাড়াই শুধুমাত্র থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়ে ভালো আছি।
বাংলাদেশী আরেক নাগরিক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোঃ শাহ আলম জানান, ২০১৪ সনে বুকে ব্যথা নিয়ে রাজধানী ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসকরা জানান তাঁর হার্টে ৫ টি ব্লক রয়েছে। সবগুলো ব্লকই ৮০-৯৫%। যার জন্য চিকিৎসকরা বাইপাস সার্জারির পরামর্শ দেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শাহ আলমের পরিবার হাসপাতালের কাউন্টারে টাকাও জমা দেন। কিন্তু বাইপাস সার্জারি করার আগের দিন বিকেলে কাউকে কিছু না বলেই হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে যান শাহ আলম। এরপর থেকেই বাইপাস ছাড়া বিকল্প চিকিৎসা খুঁজছিলেন তিনি। পরে তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে চেন্নাইয়ের “অক্সিমেড হাসপাতাল” এর বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি থেরাপির মাধ্যমে করা হয় জেনে চলে আসেন তিনি। মিস্টার শাহ আলম আরো জানান, অক্সিমেড হাসপাতালের চীফ ডাক্তার আইয়াজ আকবর এর তত্বাবধানে ৪২ দিনের চিকিৎসায় কোনো রকম সার্জারি ছাড়াই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন তিনি। তিনি বলেন, এখান থেকে চিকিৎসা করে দীর্ঘ ৮ বছর ধরে তিনি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন।
ইনাম/সময়নিউজবিডি টুয়েন্টিফোর।
Leave a Reply