সংবাদ শিরোনাম
উদ্যোক্তা: কমলগঞ্জের মেহেরুননেছা,সংসার সামলেই করেছেন বিশাল গরুর খামার

উদ্যোক্তা: কমলগঞ্জের মেহেরুননেছা,সংসার সামলেই করেছেন বিশাল গরুর খামার

শাব্বির এলাহী,কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
মৌলভীবাজারের প্রান্তিক এক গৃহবধু মেহেরুন্নেছা। সংসার সামলানোর পাশাপাশি শ্বশুরের অনুপ্রেরণায় বাড়ীর পাশেই গড়ে তুলেছেন বিশাল এক গরুর খামার। স্বামীর হাত ধরে ২০০২ সালে স্নাতক সম্পন্ন করার পর কমলগঞ্জ উপজেলার নৈনারপার বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী খতিব মিয়ার মেয়ে মেহেরুন নেছা বেগমকে বিয়ে দেন পাশের গ্রাম জালালপুরের হাজী আসদ্দর আলীর ছেলে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হানিফুর রহমান বেলালের সাথে। বিয়ের পর স্বামী,শ্বশুর-শাশুড়ী,ভাসুর ননদদের উৎসাহে মেহেরুননেছা বেগম পা রেখেছিলেন নতুন সংসারে। সংসারটা একটু গুছিয়ে নেওয়ার পর ঘরকন্নার পাশাপাশি গড়ে তুলেন গরুর খামার। উৎসাহ যোগান স্বামী হানিফুর রহমান। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হানিফুর রহমান হাজারো ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারেন না স্ত্রীকে। মেহেরুননেছার স্বপ্নযাত্রায় অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেন শ্বশুর হাজী আসদ্দর আলী। দুই ভাসুর আলতাফুর রহমান ও আলাল মিয়া ভাতৃবধূর কর্মযজ্ঞে সঙ্গী হন। ২০১৪ সালে ১২টি গরু নিয়ে যে স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয়েছিলো, তা আজ বিশাল কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। একটি শেডের ছায়া দিয়ে শুরু হওয়া সেই খামারে এখন ছায়া দেয় ৪টি শেড। খামারটি থেকে প্রতিদিন গড়ে এখন সাড়ে ৪শ থেকে ৬শ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। মাংসের যোগানও দেয় খামারটি। প্রতি বছর কোরবানির ঈদে ৮/১০টি ষাঁড় বিক্রি করতে পারেন মেহেরুননেছা। সব মিলিয়ে গড়ে প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকা আয় হয় এ খামার থেকে। স্বামী চাকরিজীবী। নিজেও স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। একটু চেষ্টা করলে হয়তো নিজেও একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারতেন মেহেরুননেছা। তিনি সে পথে হাঁটেননি। শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবেননি তিনি। তার হাত ধরে আরও কিছু মানুষের ভাগ্যকেও বদলে দিতে চান তিনি। সে স্বপ্ন থেকেই খামারটির প্রতিষ্ঠা। এখন তার এ খামার থেকে গোটা বিশেক পরিবারের জীবিকার যোগান হয়।

ছোট পরিসরে খামারটি শুরু করার পর শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেনেন আরও ১৯টি গরু। তারপর এগিয়ে চলে তার স্বপ্নযাত্রা। স্বামী, শ্বশুর ভাসুররা তো সঙ্গেই আছেন- মেহেরুননেছা তার এ স্বপ্নের সাথে জড়িয়ে রেখেছেন তার শাশুড়িকেও। খামারের নামের সাথে যুক্ত করেছেন শাশুড়ির নাম। রহমান মরিয়ম (আরএম) ডেইরি ফার্ম অ্যান্ড অ্যাগ্রো ফিসারিজের মরিয়ম হচ্ছেন তার শাশুড়ি।
আরএম ডেইরি ফার্ম অ্যান্ড অ্যাগ্রো ফিসারিজের অবস্থান চায়ের দেশ মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুরে। ধীরে ধীরে খামারের পরিসর যখন বাড়তে থাকে তখন বাড়তি লোকবলের প্রয়োজন দেখা দেয়। লোকবল নিয়োগে স্থানীয় বেকার যুবকদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। সকলের পরিশ্রমে সাফল্যের পথে হাঁটতে থাকে আরএম ডেইরি ফার্ম। ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে খামারটি পরিণত হয় একটি আদর্শ খামারে। উৎপাদন বাড়ে, গরুর সংখ্যা বেড়ে হয় দেড় শতাধিক। উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে খামারের পরিসরও বাড়ে। গরুর খামারের সাথে যুক্ত হয় মাছের খামারও। ফলের বাগানও যুক্ত হয় খামারের পরিসরে। এগিয়ে যাওয়ার এ যাত্রায় সঙ্গী হয় পূবালী ব্যাংকও। খামারের উন্নয়নে ঋণ দেয় ব্যাংকটি। ব্যাংকটির আদমপুর বাজার শাখা ব্যবস্থাপক সুমিত সেন জানান, মূলতঃ সে ঋণের উপর ভর করে আরও দুইটি শেড নির্মাণের কাজ চলছে খামারে। পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়েই তৈরি করা হয় অবকাঠামো। শেডগুলোর পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা, গরু বাছুরের খাবারের সুবিধা, বিশ্রামের জন্য পর্যাপ্ত পরিসর এবং বেলা শেষে মুক্ত পরিবেশে গোচারণের ব্যবস্থা রয়েছে এই খামারে। যা গরুগুলোকে সুস্থতায় বেড়ে উঠতে সহায়তা করছে। খামারের দক্ষিণ সীমানায় নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক সুবিধা সংবলিত দ্বিতল ফার্ম হাউজ। ফার্ম ব্যবস্থাপনা কার্যালয়, রেস্ট হাউজসহ নামাজের স্থান রাখা হয়েছে এখানে।খামারে রয়েছে ৩টি পুকুর। যাতে মাছ চাষ করা হয়। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বিক্রিও করা হয়। পুকুর পাড়ে নারকেল, সুপারি, লেবু, পেয়ারা, আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল নানা জাতের ফলদ গাছ লাগানো হয়েছে। বিশেষ করে চলতি মৌসুমে পুকুরপারে পরীক্ষামূলকভাবে ড্রাগন ফলের চাষ করে আশাতীত ফলন মিলেছে। খামারের ভেতরে বনজ বৃক্ষও রোপণ করা হয়েছে। পুকুর পাড়ের একটি ঘরে পরীক্ষামূলকভাবে পালন করা হচ্ছে কবুতর। আছে তিতির, টার্কিও।

গাছে শোভা পাচ্ছে ড্রাগন ফল।


মেহেরুননেছার সাথে কথা হয় তার স্বপ্নের খামার নিয়ে। বললেন, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’প্রকল্পের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই আমি এ খামার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হই। নিজেকে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি কিছু মানুষের জীবিকার সংস্থান করতে পারছি এটাই আমার বড় পাওয়া। আমার স্বামী তার কর্মব্যস্ততার ফাঁকেও আমাকে সহযোগিতা করে চলেছেন। আমার শ্বশুর-ভাসুররা আমাকে সাহস না যোগালে আমার একার পক্ষে এ কর্মযজ্ঞ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হত না।
কমলগঞ্জ উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মাইনউদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার জানামতে মেহেরুননেছা বেগমের এ খামারটি মৌলভীবাজার জেলার একটি শ্রেষ্ঠ ও বৃহৎ

মেহেরুন্নেসার ডেইরি ফার্ম।

খামার। পরিবেশের কোন ক্ষতি না করেই এ রকম একটি উদ্যোগ যেমন স্থানীয় বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তেমনি এলাকার পুষ্টিজাত চাহিদা মিটিয়ে কমলগঞ্জের বাইরেও প্রতিদিন দুধ বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, ঘর সংসার সামলেও মেহেরুননেছা এতো বড় একটি খামার পরিচালনা করছেন তা দেশের অন্যান্য নারীদেরও উৎসাহিত করবে। আমরা সবসময় তার পাশে আছি।
ইনাম/সময়নিউজবিডি টুয়েন্টিফোর।

সংবাদটি পছন্দ হলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © 2017 Somoynewsbd24.Com