সংবাদ শিরোনাম
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষা সপ্তাহ’র উদ্বোধন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরকে সম্প্রসারিত করে পরিকল্পিত নগরায়ন করা হবে: গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী মোকতাদির চৌধুরী এমপি কমলগঞ্জে শমশেরনগরে রেলপথ ঘেষে জমে উঠে অবৈধ পশুর হাট; দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেটওয়ার্ক আধুনিকায়নের লক্ষ্যে বাংলালিংক ও হুয়াওয়ের চুক্তি ডেঙ্গু ঠেকাতে সোমবার থেকে মাঠে নামছে ডিএনসিসি অবৈধভাবে ভারতে গিয়ে আটকে পড়া ১৩ বাংলাদেশী দেশে ফিরেছেন শেষ হলো সাহিত্য একাডেমির ৭ দিনব্যাপী “বৈশাখী উৎসব।। সচিব খলিল আহমদকে বৈশাখী উৎসব সম্মাননা প্রদান সরাইলে উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন বিএনপির প্রার্থী তপু লস্কর নবীনগরে তুচ্ছ ঘটনায় সংঘর্ষে একজন নিহত ও আহত-৩।। আটক-৪ কমলগঞ্জে নিরাপদ সড়ক চাই’র আইডি কার্ড বিতরণ ও পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত

প্রয়াত ভাষা সৈনিক মুহম্মদ মুসা স্যার কে নিয়ে স্মৃতিচারণ।। বৃহৎ মানুষের সাথে ক্ষুদ্র স্মৃতি; মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

প্রয়াত ভাষা সৈনিক মুহম্মদ মুসা স্যার কে নিয়ে স্মৃতিচারণ।। বৃহৎ মানুষের সাথে ক্ষুদ্র স্মৃতি; মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

ভালোবাসা যেখানে মুখ্য; অর্থ-বিত্ত, যশ-খ্যাতি সেখানে গৌণ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যে কয়েকজন গুণী মানুষের সাথে আমার মেশার সুযোগ হয়েছে বা যাদের সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে, তঁাদের কয়েক জনকে কাছ থেকে দেখে এই ভেবে আমি অবাক হয়েছি যে তঁাদের এতো গুণ, যোগ্যতা, পরিচিতি থাকার পরও তঁারা কেনো ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পড়ে থাকেন। তঁারা যদি শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে ব্যস্ত না থেকে জাতীয় পর্যায়ে নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতেন, তাহলে দেশময় খ্যাতি অর্জন করতে পারতেন। পারতেন অর্থ বা ক্ষমতার মালিক হতে। কিন্তু তঁারা তা না করে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে নিয়েই কেন ব্যস্ত থাকেন। নিজের কাছে করা আমার সে প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে “ভালোবাসা যেখানে মুখ্য; অর্থ-বিত্ত, যশ-খ্যাতি বা ক্ষমতা সেখানে গৌণ।”
আর তাইতো কিছু মানুষের কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতি আপন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ, রাস্তা-ঘাট, আলো-বাতাস, নদী-খাল, গাছ-পালা, পশু-পাখি তঁাদের কাছে এতো আপন যে; তঁারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবকিছুকে ভালোবেসে নিজের জীবন-যৌবন কাটিয়ে দেন এখানেই। তঁারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস আর ঐতিহ্যর ধারক-বাহক হয়ে ভুলে যান দেশজোড়া তঁার নিজের নাম ডাক তুলে ধরতে, অর্থের লোভকে দু’হাতে ঠেলে, ক্ষমতাকে পদদলিত করে, খ্যাতির মোহকে পিছু ফেলে কিছু মানুষ ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে আপন করে নেন সারা জীবনের জন্য।
সদ্য পরলোকগত মুহম্মদ মুসা স্যার তেমনি একজন মানুষ। যিনি আপাদমস্তক ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ভালোবাসার মানুষ। এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পবিত্র মাটিতে যার জন্ম, এর আলো বাতাসেই যার বেড়ে ওঠা, এ মাটিতেই তঁার চির শয্যা। আলোকিত, বর্ণাঢ্য জীবনের আধিকারী তিনি। একজন মানুষ তঁার সময়ের সবচেয়ে সঠিক যে কাজটি করা প্রয়োজন। মুসা স্যার সেগুলিই করে গেছেন। কৈশরে তিনি ভাষা আন্দোলনে সংযুক্ত থেকে “ভাষা সৈনিক” হয়েছেন। তরুণ বয়সে ছাত্রআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে কলেজের ভিপি হয়েছেন। যৌবনে সংযুক্ত হয়েছেন সাংবাদিকতায়। পরিণত বয়সে হয়েছেন একজন শিক্ষক।
শিক্ষক হয়ে ছাত্র পড়িয়েছেন, আলোকিত মানুষ গড়েছেন। সাংবাদিক হয়ে সাংবাদিকবৃন্দের নেতা হয়েছেন, অনেক গুণী সাংবাদিক তৈরি করেছেন তিনি। পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিজে লেখালেখি করেছেন। লেখক-পাঠক তৈরি করছেন। বৃক্ষ প্রেমিক মানুষ ছিলেন তিনি। তঁার হাতে লাগানো শতশত গাছ আজও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে সবুজ করে রেখেছে। ফল, ফুল, ছায়া দিচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরির পেছনের সুনিপুণ পরিকল্পনা, বলিষ্ঠ হাত এবং সূক্ষ্ম কারিগর মুসা স্যার।
মুসা স্যারকে চেনেন না ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে এরকম কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি নেই। তরুণ প্রজন্মের কাছেও তিনি সমধিক পরিচিত। গত সত্তর বছরে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এসেছেন তঁারা সবাই মুসা স্যারকে চেনেন। তঁারা কখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে স্মরণ করলে সাথে মুসা স্যার কেও স্মরণ করেন। যেন মুসা স্যার আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া এক অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মানুষ অনেকভাবে নিজেকে খ্যাতিমান করে তোলেন। তাদের জীবনে থাকে সুখ্যাতি আর কুখ্যাতি। মুসা স্যারের বেলায় শুধুই সুখ্যাতির পরিচিতি। এই যে এই মানুষটির এতো পরিচিত, জনপ্রিয়তা। তিনি কিন্তু নিজের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে কখনো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চাননি। নিজের পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে অর্থের প্রাচুর্য সংগ্রহে ব্যস্ত হননি। তিনি সংগ্রহ করেছেন বই, বিলিয়েছেন বই, বিলিয়েছেন জ্ঞান। ছড়িয়েছেন ভালোবাসা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রিয় মানুষ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াপ্রেমী মানুষ মুসা স্যারের অমর সৃষ্টি “ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিবৃত্ত” নামক বই সম্পাদনা। যা যুগ থেকে যুগের মেলবন্ধন রচনা করবে প্রতিটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেমিক মানুষের মাঝে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সূতিকাগার হয়ে থাকবে এই বইটি। আর মুসা স্যারও তঁার সকল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আকাশে একটি উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হয়ে থাকবেন। যে নক্ষত্র সদা প্রোজ্জ্বল্যমান।
(মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ-০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯খ্রি.)
বৃহৎ মানুষের সাথে ক্ষুদ্র স্মৃতি। (পর্ব-০২)
সদ্য প্রয়াত ভাষা সৈনিক মুহম্মদ মুসা স্যারের সাথে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। ২০০৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই। সে বছরই কলেজে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কর্মসূচি কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু করেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, শ্রদ্ধেয় প্রফেসর জনাব আবদুন নূর স্যার। সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন আমাদের শ্রেণি শিক্ষক, শ্রদ্ধেয় জনাব ওসমান গণী সজীব স্যার এবং সহকারী ছিলেন জনাব মো. আব্দুল হান্নান আংকেল।
প্রতি শুক্রবার ১০টায় কলেজের এল.টি কক্ষে ক্লাস ছিল। এমনি একটি ক্লাসে একদিন সজীব স্যার মুসা স্যারকে অতিথি করে নিয়ে আসেন। ক্লাসের নিয়ম ছিল আমরা বিগত সপ্তাহে যে বইটি পড়েছি সেটির উপর ১০টি ভালো লাগার লাইন ও ১০টি খারাপ লাগার লাইন উল্লেখ করে তার উপর আলোচনা লিখে আনা এবং ক্লাসে এসে ম ে দঁাড়িয়ে সে বইটির আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে বক্তব্য রাখা।
সেদিন যে কয়েকজন বক্তব্য প্রদান করেছিলো তারমধ্যে আমিও ছিলাম। আমাদের সবার আলোচনা শেষে সজীব স্যার মুসা স্যারের পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাদের সাথে, যিনি এতক্ষণ আমাদের আলোচনা শুনছিলেন। জনাব সজীব স্যার মুসা স্যারের যে পরিচিত আমাদের সামনে তুলে ধরলেন তাতে আমার মনে হলো তিনি যদি আমাদের বক্তব্যর আগে মুসা স্যারের পরিচয় দিতেন তাহলে আমরা হয়ত নিজেদের বক্তব্য গুলি উপস্থাপন করতে পারতাম না।
সজীব স্যারের মুখে মুসা স্যারের পরিচিতি পেয়েই আমরা তঁার প্রতি অনুরক্ত হয়ে যাই এবং মুসা স্যারের বক্তব্য শুনে তঁার ভক্ত হয়ে যাই। সেদিন ক্লাস শেষে আমরা সবাই মুসা স্যার আর সজীব স্যারের সাথে একসাথে বের হচ্ছিলাম। বের হতে হতে নানান কথার ফঁাকে মুসা স্যার আমার দেয়া বক্তব্যর প্রশংসা করলেন। গুণী মানুষের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে আমি উনার প্রতি আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি।
তারপর থেকে মুসা স্যারের সাথে প্রায়ই দেখা হতো। কখনো তিনি অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ স্যারের রুমে যাচ্ছেন বা ফিরে আসছেন। কখনো নিয়াজ মোহাম্মদ স্কুলের দিকে যাচ্ছেন। কখনো ডাক বাংলার মোড় বা শহরের দিকে হঁাটছেন। স্যারের সাথে দেখা হলেই সালাম দিতাম, দু’কদম স্যারের সাথে হঁাটতাম। স্যার কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। স্যারের সাথে কুশলাদির উত্তর দিয়ে এটা ওটা জিজ্ঞেস করতাম। একসময় এটা নিয়মিত হয়ে গেলো। স্যার যেহেতু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গবেষক তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে এটা সেটা প্রশ্ন করতাম। স্যার আগ্রহ নিয়ে একের পর এক গল্প আর ইতিহাস গুলি বলতেন।
নানান সময় মুসা স্যারের সাথে হঁাটতে হঁাটতে তঁার মুখে এই কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস শুনেছিলাম। শুনেছিলাম এই শহিদ মিনার নির্মাণের ইতিহাস। শুনেছিলাম অধ্যাপক হরলাল রায় স্যার, কবি আসাদ সরকার স্যার, অধ্যাপক এ কে এম হারুন অর রশিদ স্যার আর কবি আল মাহমুদ স্যারের নানান কথা। নিয়াজ মোহাম্মদ স্কুল কীভাবে প্রতিষ্ঠা হলো, এটির নাম জর্জ মাইনর স্কুল বা কলেজিয়েট স্কুল কেন ডাকা হতো। স্যারের কাছেই শুনলাম যে মাঠটি আমরা কলেজ মাঠ নামে চিনি এটি আসলে কলেজের মাঠ নয়, এটি নিয়াজ মোহাম্মদ স্কুলের মাঠ। অবকাশ বা ফারুকী পার্ক প্রতিষ্ঠার গল্প। সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার কথা। কুরুলিয়া খাল বা এন্ডারসন খালের কাটার কথা। নিয়াজ মোহাম্মদ স্টেডিয়াম আর এসডিওর মেলার কথা মুসা স্যারের কাছ থেকে আমার শোনা। আরো অনেক কিছু শুনেছি যার অনেকটিই আমার মনে নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্পর্কে জানতে আমি একটু বেশি আগ্রহী ছিলাম, কারণ জন্মসূত্রে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান হলেও বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমরা সপরিবারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাহিরে ছিলাম। তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। মুসা স্যার ছিলেন আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্পর্কে জানার প্রথম ও সর্বোত্তম পাঠ এবং শিক্ষক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ উপলব্ধি করে একদিন তিনি কলেজের গেটে কাছে আমাকে দেখে ডাকলেন। বললেন- ভাতিজা তোমাকেই খুঁজতে ছিলাম। স্যার আমাকে খুঁজছেন শুনে আমি ততোধিক ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললাম, জি স্যার কেন খুঁজছিলেন। স্যার তখন নিজের হাতে থাকা একটি স্মরণিকা আমার হাতে দিয়ে বলেন, এই স্মরণিকাটা পড়বা, এইটা পড়লে তুমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেক ইতিহাস আর ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে জানতে পারবা।
স্মরণিকাটি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব থেকে প্রকাশিত, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেক খ্যাতিমান ব্যক্তি, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি জনাব মনসুর কামাল সম্পাদিত “কালোত্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়া” শীর্ষক স্মরণিকা। এটি আজও আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। এটি হাতে দেওয়ার পর স্যার এটাও বলেছিলেন যে “ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিবৃত্ত” বইটা আমার কাছে খুব বেশি সংখ্যক নাই, তুমি পাবলিক লাইবেরি বা সরকারি গণগ্রন্থাগারে পাবে। আমি ওখানে কপি দিয়ে রেখেছি”।
মুসা স্যার একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন এই যে, শহিদ মিনারের পেছনের গাছগুলি দেখছ, এগুলি আমার হাতে লাগানো, ফারুকী পার্কের বড় বড় অনেক গাছসহ শহরের অনেক স্থানে আমার হতে বা উদ্যোগে লাগানো গাছ আছে। কোন কোন স্থাপনা করার সময় কোন কোন গাছ কাটা পরেছে সেগুলিও তিনি অবলীলায় বলতে পারতেন। তিনি বলতেন শোন ‘তোমরা যে গাছের ছায়ায় বসে সময় কাটাও, ফুল ছেড়ো, ডাল ভাঙ্গ, এগুলি আমার সন্তানের মত আদর যত্নে বড় করা। কোন গাছ কাটা পড়লে আমি ভীষণ কষ্ট পাই। তোমরা সুযোগ পেলেই নিজে নিজে গাছ লাগাবে, অন্যদেরও গাছ লাগাতে বলবে। কারণ গাছ আমাদের অন্যতম বন্ধু। বই এবং গাছের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না’।
স্যারের সাথে আমার এই হঁাটতে হঁাটতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গল্প শোনা প্রায় বছর দেরেক ছিল। স্যারের সাথে হঁাটতে দেখে আমার কয়েকজন বন্ধু একবার আমাকে বলেছিল মনির ঐ বুড়া লোকটা তোর কি হয়। অনেক সময় তঁার সাথে তোকে দেখি। আমি স্যারের পরিচয় দিয়ে বলেছিলাম দেখতে সাদামাটা এই লোকটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন সম্মানিত ব্যক্তি, তিনি সাংবাদিক, শিক্ষক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গবেষক, লেখক। আমি তঁার কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস জানতে চেষ্টা করি। (মুসা স্যার সাদা-মাটা জীবনের অধিকারী হলেও তখনও “সাদা মনে মানুষ” খেতাবটি পাননি) বন্ধুদের একজন মন্তব্য করেছিল এক কবি আরেক কবির দেখা পেয়েছিস। (ততদিনে আমি বন্ধু মহলে কবি হিসেবে ছোটখাটো একটা পরিচিত পেয়েছিলাম) বন্ধুর মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে আমি বলেছিলামÑ “কার সাথে কার তুলনা করতেছিস, আমিতো তঁার পায়ের ধুলো পাওয়ারও যোগ্য নই”।
একসময় আমি ভাবতাম স্যার আমাকে পেলেই কথা বলতে আগ্রহী কেনো। অনেক পরে এটার উত্তর জানতে পরেছি। মুসা স্যার আসলে আমার প্রতি নয়, তিনি এমন প্রত্যেক মানুষের সাথে কথা বলতে আগ্রহী যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জানতে চায়, যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ভালোবাসে। কারণ তিনি নিজেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেমিক।
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ (০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রি.)
বৃহৎ মানুষের সাথে ক্ষুদ্র স্মৃতি। (পর্ব-০৩)
সদ্য প্রয়াত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খ্যাতিমান ব্যক্তি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া গবেষক, ভাষা সৈনিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, সাদা মনের মানুষ মুহম্মদ মুসা স্যারকে নিয়ে লিখতে লিখতে ভাবছিলাম কাজটি আমি ঠিক করছি কি না। কারণ জ্ঞানে, গুণে ও মানে মুহম্মদ মুসা স্যার আমাদের কাছে সমুদ্রসম। যে সমুদ্রের আমি জেলে, মাঝি বা নাবিক নই, সে সমুদ্রের গতি-প্রকৃতি, স্বভাব বা গভীরতা সম্পর্কে আমি কীইবা লিখতে পারব আর কতটুকু লিখতে পারব। অর্থাৎ যে মুসা স্যার সম্পর্কে আমি তেমন কিছুই জানি না, যার সোনালি দিনের কর্মকাণ্ড গুলি আমি কাছ থেকে দেখব দূরের কথা সে সময় আমার জন্মই হয়নি, সেই ব্যক্তিকে নিয়ে লিখা কতটা যৌক্তিক বা বোধসম্পন্ন কাজ।
পরে ভাবলাম আমি নাই বা হলাম ঐ সমুদ্রের জেলে, মাঝি বা নাবিক। একজন ভ্রমণ পিয়াসু দর্শক হিসেবে নিজের দেখা অভিজ্ঞতা বর্ণনাতো করা যেতেই পারে। একজন সাধারণ পর্যটক যেমন সমুদ্রের গভীরতা মাপতে পারে না, তেমনি মুসা স্যারকে নিয়ে লিখে আমি তঁার যোগ্যতা বা গুণের সামান্যতম অংশও তুলে ধরতে পারবো না। আমি শুধু সে অংশটুকুই লিখতে চাচ্ছি তঁার যতটুকুু স্মৃতি আমার কাছে আছে। অর্থাৎ আমার এই লেখা শুধুই স্মৃতিচারণ মূলক, কারো কাজের মূল্যায়ন নয়।
২০০৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, মহান শহিদ দিবস। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ও সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনায় শহিদ দিবস উদ্‌যাপন করা হবে। আমরা তখন দ্বিতীয় বর্ষে। আমরা মানবিক শাখার কয়েকজন বন্ধু সিদ্ধান্ত নিলাম শহিদ দিবস শ্রেণি আমরা একটা দেয়ালিকা প্রকাশ করব। বিষয়টি আমাদের শ্রেণি শিক্ষক জনাব নজরুল ইসলাম স্যারকে জানানো হলে স্যার আমাদেরকে উৎসাহ দিলেন। জনাব সেলিনা ম্যাডাম, জনাব নুরে আলম সিদ্দিকী স্যার এবং জনাব নজরুল ইসলাম স্যারের তত্ত্বাবধানে আমাদের দেয়ালিকার প্রকাশের কার্যক্রম শুরু হলো।
স্যারদের নির্দেশে দেয়ালিকার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহের জন্য কলেজের নোটিশ বোর্ডে এর পাশে হাতে লিখা বিজ্ঞাপন লাগানো হলো, একাদশ শ্রেণির প্রথম বর্ষ আর দ্বিতীয় বর্ষের প্রত্যেক শাখায় ঘোষণা দিয়ে আসা হলো। লেখা সংগ্রহ হলে নজরুল স্যার সেগুলি বাছাই করলেন। বন্ধু শামিম রেজার পীর বাড়ির বাসায় আমি, শামিম রেজা, মাহমুদুল হক, ওয়ালিউল্লাহ মাহমুদ, রিফাত বিন আইয়ুব সহ আরো কয়েকজন বন্ধু মিলে রাত জেগে জেগে দেয়ালিকার কাজ করা হলো।
দেয়ালিকায় একটি লেখার জন্য আমরা মুসা স্যারের কাছেও আবদার করে ছিলাম। স্যার তখন বললেন- দেয়ালিকার জায়গা ছোট, আমাদের লেখা নিয়ে জায়গা নষ্ট না করে ছাত্র-ছাত্রীদের দু-একটা লেখা বেশি নাও। আমরা বললাম ঠিক আছে স্যার, তাহলে একটা বাণী দিয়েন। সেই দেয়ালিকায় অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ স্যারের বাণীর সাথে ভাষা সৈনিক মুসা স্যারেরও একটি বাণী নেওয়া হয়েছিলো।
২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহরের আগেই দেয়ালিকাখানি শহিদ মিনারের কাছা-কাছি স্থানে রেখে দেওয়া হয়েছে। আর সেই দেয়ালিকা শহিদ মিনারে আসা আগত দর্শনার্থী, ছাত্র-ছাত্রীরা ও শিক্ষকবৃন্দ যারা দেখতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে মুসা স্যারও ছিলেন। সবাই দেয়ালিকার প্রশংসা করছিলেন। অনেই বলাবলি করছেন যে বহু বছর পর কলেজে দেয়ালিকা প্রকাশ করা হলো।
আজ আমরা সেই সকল বন্ধুরা সারাজীবন এটা গর্ব করে বলতে পারি যে, কোনো এক শহিদ দিবসে শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে আমাদের ক্ষুদ্র একটি সৃষ্টিশীল কাজে একজন ভাষা সৈনিক আমাদের পাশে ছিলেন। যা আমাদের কাছে চির গৌরবের। এর কয়েক মাস পর আমরা আরেকটি দেয়ালিকা তৈরি করেছিলাম দুটি দেয়ালিকায় প্রদর্শন শেষে কলেজের লাইব্রেরি রুমে রাখা হয়েছিল। লাইব্রেরি রুমটি যখন আধুনিকায়ন করা হলো তখন দেয়ালিকা দুটি কোথায় রাখা হয়েছে আমাদের আর জানা নেই।এর পরের মাস আমরা বিশ্ব সাহিত্যের বন্ধু মাহমুদ, রিফাত, হৃদয়, পাপেল, সাব্বির, সোহলে, সনি, তানজিনা, তন্বী, লিটনসহ আরো কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম কলেজে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করব। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রর সংগঠক ও আমাদের শ্রেণি শিক্ষক জনাব ওসমান গণী সজীব স্যারকে জানানো হলো। কিন্তু স্যার আমাদের এই বলে সতর্ক করলেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। সব ধরনের সভা, সমাবেশ, গণজমায়েত নিষিদ্ধ। এ অবস্থায় আমরা তোমাদের অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিতে পারি না। কিন্তু তবুও আমরা সীমিত আকারে দিবসটি উদ্‌যাপন করতে চাইলাম। স্যার তখন বলেন ঠিক আছে তোমরা এল.টি রুমে অনুষ্ঠান না করে, শিক্ষক কনফারেন্স রুমে অনুষ্ঠান কর। আর আমি তোমাদের সরাসরি সহযোগিতা না করতে পারলেও পিছন থেকে সহযোগিতা করব।
কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি থাকবে না বলে আমরা কোন আর্থিক সহযোগিতাও পাবো না। আমরা বন্ধুরা নিজেরা চঁাদা দিলাম এবং কলেজের বিভিন্ন বন্ধুদের কাছ থেকে দশ টাকা, বিশ টাকা করে চঁাদা উঠিয়ে সেই স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠান আয়োজন করলাম। জনাব সজীব স্যারের নির্দেশনায় অনুষ্ঠানে তৎকালীন বিদায়ী প্রফেসর আবদুন নূর স্যার ও উপাধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা স্যারের সাথে মুহম্মদ মুসা স্যারও অতিথি হয়ে এসেছিলেন। সেদিন মুসা স্যার মন্ত্রমুগ্ধর মত বক্তৃতা করেছিলেন। আর নূর স্যার দিয়েছিলেন তেজোদ্দীপ্ত ভাষণ। সেদিন তঁারা সকলেই আমাদেরকে বিরূপ পরিস্থিতেও ভালো কাজ করার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন।
সে সময়ের আরেকটি ঘটনা, একদিন সন্ধ্যায় ফারুকী পার্কের পাবলিক লাইব্রেরিতে পত্রিকা পড়তে গিয়েছি। সেখানে মুসা স্যারও কি কাজে গিয়েছিলেন। সম্ভবত কোনো বই খুঁজছিলেন। স্যারকে সালাম দিতেই বলেন তুমি কি এখানে বই পড়তে এসেছো। আমি বললাম স্যার, মাঝে মাঝে পত্রিকা আর ম্যাগাজিন গুলি পড়িতে আসি। স্যার বললেন বই পড়ো না? আমি বললাম; সব বই সেলফে তালা দেয়া থাকে। ওনাদের সাথে পরিচয় নাই, তাই বই পড়া হয় না। তিনি বললেন এই কারণে তুমি বই পড়ো না! পত্রিকা পড়তে হবে, বইও পড়তে হবে। আমি বললাম স্যার এখানে বই না পড়লেও কাজিপাড়ার লাইব্রেরিতে বই পড়ি। (কাজীপাড়া-প্রয়াত ডাক্তার রফিকুল ইসলাম চেম্বারের দোতলায় জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার ছিল, যেটা এখন কুমারশীল মোড়) তখন স্যার বললেন চল তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই, তিনি আমাকে সেখানের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুজন লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর থেকে সেখানেও মাঝে মাঝে বই পড়তে যেতাম।
ছোট বেলায় আব্বার সাথে যখন শহরে আসতাম তখন ফারুকী পার্কের সামনে যেতেই এই লাইব্রেরিটি দেখতাম। বড় বড় দুটি সাইনবোর্ড ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাবলিক লাইব্রেরি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইসলামিক সেন্টার। ২০০৩/০৪ সালের দিকে এক মাদ্রাসা পড়ুয়া বড় ভাইয়ের কাছে বললাম এটা আবার কি লাইব্রেরি লাইব্রেরি খোলা দেখলাম না। ঐ বড় ভাই বললেন, আরে বোকা এটাতো প্রতিদিন সন্ধ্যায় খোলে। তিনি একদিন সন্ধ্যায় আমাকে এখানে নিয়ে এলেন। ভাদুঘর আলিয়া মাদ্রাসার একজন শিক্ষক লাইব্রেরির দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ইসলামিক সেন্টারের দায়িত্বে ছিলেন। উনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে উপরতলাটা ঘুরে ঘুরে দেখালেন। দেখলাম সারি সারি আলমারিতে অনেক ইসলামি বই।
পরে আসলাম নীচ তলায়। এখানে এসেতো আরো অবাক। চারিদিকে বড় বড় আলমারিতে নতুন পুরাতন কত বই। সব নানান ভাগে ভাগে সাজিয়ে রাখা। মাঝখানে বড় বড় কয়েকটা টেবিলে অনেক মানুষ পত্রিকা ম্যাগাজিন, বই পড়ছে। সেখানে একটি রেজিস্ট্রার ছিল। নিজের নাম, ঠিকানা লিখে কি পড়ব বা পড়ছি তা লিখতে হতো। তারপর থেকে সেখানে যতবার গিয়েছি শুধু পত্রিকা বা ম্যাগাজিনই পড়েছি। এখানকার বই এখানে বসেই পড়া যায় তা জানি। কিন্তু সংকোচে কখনো তাদের কাছে বই পড়তে চাওয়া হয়নি। এর দু, তিন বছর পর এবার এই লাইব্রেরির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ মুসা স্যার নিজেই আমাকে এখানে বই পড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। যা আমার কাছে একটি স্মরণীয় স্মৃতি।
(মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ-১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রি.)
২০০৯ সাল। শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে (তৎকালীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল চত্বর) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা চলছে। মেলার একটি বইয়ের স্টল দিয়েছে আমার সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঝিলমিল শিশু-কিশোর সংগঠন। এই স্টলকে ঘিরে সংগঠনের নানা বয়সী ছেলে-মেয়ে সমাগম হয়েছে মেলার মাঠে। বিকেলে মুসা স্যারকে দেখলাম ঘুরে ঘুরে স্টল পরিদর্শন করছেন। তখনও মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। স্যারকে অনুরোধ করলাম আমাদের সংগঠনের সদস্যদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য। তিনি সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। তাৎক্ষণিক মেলার পিছনের দিকে চেয়ারগুলো গোল করে আমরা প্রায় ২০/২৫ জন সদস্য বসে পড়লাম। সবার সামনে মুসা স্যারের পরিচিতি তুলে ধরলাম। সেইদিন তিনি ভাষা আন্দোলনের ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও এই আন্দোলনে তঁার অংশগ্রহণের নানা ইতিহাস বর্ণনা করলেন। উপস্থিত সকলে মুগ্ধ হয়ে একজন ভাষা সৈনিকের মুখে শুনলাম ভাষা আন্দোলনের অনন্য ইতিহাস। পরদিন স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে এই সংবাদ ছাপা হল।
২০১০ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারির ঘটনা। সকালবেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ সংলগ্ন শহিদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছে আমাদের সদ্য প্রতিষ্ঠিত সংগঠন কবির কলমের সদস্যরা। শহিদ মিনারের কাছাকাছি যেতেই দেখলাম মুসা স্যার শহিদ মিনারের কাজ শেষ করে শহরের দিকে যাচ্ছেন। স্যারকে সালাম দিয়ে অনুরোধ করলাম আমাদের সঙ্গে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ করার জন্য। স্যার আমাদের সঙ্গে হঁাটলেন এবং শহিদ মিনারে স্যারকে সাথে নিয়ে আমরা ভাষা শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ফুলেল শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম। এটিও আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি।
এরপর স্যারের সঙ্গে প্রায় রাস্তায় চলতে পথে। তাঁর সাথে কথা বলতে বলতে একসঙ্গে হেঁটেছি বহুবার। একজন বিশাল মানুষের ছায়ার সাথে হাঁটার অনুভূতি সত্যিই অন্যরকম। এ আমার পরম সৌভাগ্য। স্যারের সাথে আরো দেখা হতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কখনো তিনি অনুষ্ঠানের ম ে বা কখনো আশেপাশে ঘোরাফেরা করছেন। টুকটাক বিষয়ে কথা হতো নিয়মিত। সবচেয়ে বেশি কথা হতো সুর সম্রাট ওস্তাদ দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনে। সংগীতাঙ্গনের সাধারণ সম্পাদক, শ্রদ্ধেয় কবি আবদুল মান্নান সরকার স্যারকে কেন্দ্র করে সেখানে প্রায়ই আড্ডা হতো। সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতা অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গের আসা-যাওয়া ছিল। কখনো অন্য কারো সাথে, কখনো একা মাঝে মাঝে আমিও যেতাম সেখানে। মুসা স্যারও সেখানে যেতেন। সংগীতাঙ্গনে বসে বসেও স্যারের কাছ থেকে অনেক তথ্য শুনেছি। দুর্ভাগ্যবশত তার সবকিছু এখন আমার মনে নেই।
পৌরসভায় আমার চাকরি হওয়ার পর স্যারের সঙ্গে খুব বেশি একটা দেখা হতো না। মাঝে মাঝে রেকটোতে যেতাম পত্রিকা কেনার জন্য। মুসা স্যারকে দেখতাম রেকটোর ভিতরে অবস্থান করছেন। সালাম দিতেই তিনি আমার খেঁাজ খবর নিতেন। আমার চাকরি হওয়ার খবর জেনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি আমার জন্য দোয়া করতেন। বলতেনÑ মনোযোগ দিয়ে কাজ করবে। মুসা স্যারের সঙ্গে আমার শেষ কথা তিনি মারা যাওয়ার কয়েক মাস পূবে এই রেকটোতেই হয়।
স্যারকে শেষবার দেখেছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেক কৃতিসন্তান, বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি আল মাহমুদের মৃত্যুর পর। নিয়াজ মুহম্মদ স্কুলের মাঠে তঁার প্রিয় বন্ধুর জানাজা নামাজে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। এর সাত মাস পরে হঠাৎ করে মুসা স্যারের মৃত্যু সংবাদ পেলাম। ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে মুসা স্যার জেলার অসংখ্য ভক্তকে কঁাদিয়ে পরে চলে গেলেন। যে মাঠের কাছে মুসা স্যারের সাথে পরিচয় হয়েছিলো, সে মাঠেই স্যারের জানাজা নামাজে অংশগ্রহণ করলাম।
পরপারে ভালো থাকুক আমাদের সকলের প্রিয় ব্যক্তিত্ব ভাষাসৈনিক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া গবেষক, বই ও বৃক্ষপ্রেমিক মানুষ মুহম্মদ মুসা স্যার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাসের সোনালি পাতায়, বইয়ের কালো অক্ষরে, জেলার অসংখ্য বৃক্ষের ছায়ায় আর শতশত মানুষের অন্তরে তিনি আজীবন অমর হয়ে রইবেন।
৩০ মে ২০২৩ খ্রি.
লেখক: মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক, ঝিলমিল একাডেমি, সম্পাদক-প্রকাশক, কিচিরমিচির।

সংবাদটি পছন্দ হলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © 2017 Somoynewsbd24.Com