করোনা পরিস্থিতিতে জনসমাগমের মতো অপরাধ শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয় দেশের সবজায়গায়ই প্রতিনিয়ত ঘটছে জানিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের এমপি র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেছেন, মহামারি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকার ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে যখন সারাদেশে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে একটি ইসলামি উপদলনেতা মাওলানা যুবায়ের আহমেদ আনসারির মৃত্যুতে অনুষ্ঠিত জানায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লাখো মানুষের সমাগম ঘটানো নিঃসন্দেহে একটি গর্হিত কাজ বলে আমি মনে করি। তবে এই জানাজা প্রসঙ্গ নিয়ে একটি মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিরুদ্ধ একটি অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে। এই প্রসঙ্গ নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে আমার কিছু বলার আছে।
রবিবার (২০ এপ্রিল) সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি এ কথা বলেন ।
মোকতাদির চৌধুরী আরো বলেন, প্রথমত জানাজার নামাজ আদায় করা একটি ধর্মীয় সংস্কৃতি ও অনুশাসন। এটি প্রতিপালন করা ফরজে কেফায়া। সমাজের ৫-১০ জন লোক আদায় করলেই পুরো সমাজের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করা কোভিড-১৯ আতঙ্কের মধ্যে সরকারি বিধি নিষেধের তোয়াক্কা না করে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতার জানাজায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা লাখো মানুষের অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। এই ঘটনাটি আমিসহ সারাদেশের সচেতন মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। মহামারির মধ্যে শোকসন্তপ্ত পরিবারের পক্ষ থেকে লকডাউন ভঙ্গ করে এ ধরনের গণজমায়েতের আয়োজন সীমালঙ্ঘনের শামিল এবং অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকও বটে। ‘কিন্তু এ ঘটনার জন্য সেখানের প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি কিংবা পুরো জনপদের মানুষকে দায়ী করার প্রবণতাও একধরনের মূর্খতা। কেননা প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধিদের তেমন কিছুই করার থাকে না। মূলত এসব বিষয়ে মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রীয় নিয়ম নীতির চেয়ে তথাকথিত ধর্মীয় আবেগ বেশি কাজ করে। যদিও অধিকাংশ বিষয়ের সাথে ধর্মের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি মাওলানা যুবায়ের আহমেদ আনসারি সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। তাছাড়া এটি আমার নির্বাচনী এলাকাও না। তবে সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওপর কেউ অযৌক্তিকভাবে কিছু চাপানোর অপপ্রয়াস চালালে সেই জেলার বাসিন্দা হিসেবে আমি চুপ থাকতে পারি না। এ কথা সত্য যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জানাজায় অংশগ্রহণেচ্ছু মানুষদের যদি প্রশাসন বাধা দিত তাহলে সেখানে প্রচুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটত। তখন ওই প্রাণহানির ঘটনার দায়-দায়িত্ব কী তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াকর্মীরা গ্রহণ করতেন?। নিশ্চয় করতেন না। বরং তারা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ওপরই দায় চাপাতেন। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন, শহীদ নীরেন্দ্রনাথ ভাষা চত্বর ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদে যখন ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাণ্ডব চালিয়েছিল তখন কী তারা এর প্রতিবাদ করেছিলেন? করেননি। তখন যদি ওসব অপরাধের বিরুদ্ধে মিডিয়া সোচ্চার হতো তাহলে হয়তো শনিবারের ঘটনাটি ঘটতো না।’
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আমরা সবাই ইলেকট্রনিক, টেলিভিশন ও সোস্যাল মিডিয়ায় সবসময় প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। কিন্তু তা সারাদেশে কতটুকু কার্যকর করতে পেরেছি? আমরা কী সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পেরেছি? যখন সরকারি ছুটিতে পোশাক শ্রমিকরা ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটছিল কিংবা এবং পুনরায় ঢাকামুখী হয়েছিল তখন কী তাদের আটকাতে পেরেছি?, পারিনি। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া না সমগ্র দেশের চিত্রই এ ধরনের। তাই তো লক্ষীপুরে করোনায় সামাজিক দূরত্ব রক্ষা না করে মোনাজাতে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়।
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘শিক্ষা, সংস্কৃতি ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। এই জেলায় সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বিট্রিশবিরোধী বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত, উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম বাঙালি ব্যারিস্টার আব্দুর রসূল, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, কবি আল মাহমুদসহ অসংখ্য কৃতিসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গ্যাস দ্বারা সারাদেশের ৪০ ভাগ চাহিদা পূরণ করা হয়। অথচ একজন ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতার জানাজাকে কেন্দ্র করে সোস্যাল মিডিয়ায় তথাকথিত কিছু সংস্কৃতি ও মিডিয়াকর্মীকে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে দেখেছি।’
‘তাদের মধ্যে মার্জুক রাসেল নামে একজন তথাকথিত কবি ও নাট্যকার তার ফেসবুক পেজে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে গালি দিয়ে লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে কার্যকরী ছয় মাসের জন্য লকডাউন করা হোক। এই ছয়মাস ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বিদ্যুৎ বন্ধ করে পুরো দেশের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। ততোদিনে তাদের.….।’ আমি মনে করি তিনি যদি জানতেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ ও সার দেশের মোট ৩৫-৪০% চাহিদা পূরণ করে তাহলে হয়তো এটি লিখতেন না। যদিও গত ১৩ এপ্রিল লকডাউনের মধ্যে তার জেলায় মসজিদে নামাজ পড়া নিয়ে সংঘর্ষে যুবক নিহত হওয়ার ঘটনার সংবাদ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।’
এ ছাড়া জয়-ই-মামুনের মতো একজন দায়িত্বশীল মিডিয়াকর্মীকেও দেখলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে নিয়ে গালি দিতে। অথচ আমরা দেখেছি তার জেলার সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে একটি ছেলেকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা ও লকডাউনের মধ্যে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটিয়ে মৃত ব্যক্তির জানাজা অনুষ্ঠিত হতে। এ ধরনের অপরাধ শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয় দেশের সবজায়গায়ই প্রতিনিয়ত ঘটছে। এসব মূলত সামাজিক অজ্ঞতারই ফসল। আমাদের এসব থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজে বের করতে হবে। আর সেই পথটি হচ্ছে সকল ধর্মান্ধতা ও মানসিক বিকারগ্রস্ততা থেকে বেরিয়ে এসে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন করা। (প্রেস বিজ্ঞপ্তি)।
Leave a Reply